Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

যৌবনের মেয়াদ কত, ফিসফাস মাতব্বরদের

যেখানে তাঁরা দল বেঁধে বসেন, সেখানেই শুরু হয় ‘বিচার’। ঝিমদুপুর কিংবা ডুমো বাল্‌বের নীচে গাঁ-গঞ্জের সেই মাতব্বরেরা ঠিক করে দেন কার স্ত্রী কার সঙ্গে থাকবে বা কার যৌবনের মেয়াদ কত, কার ইজ্জত থাকবে কার যাবে। বেআইনি জেনেও তাঁদের ‘রায়’ মাথা পেতে নিতে হয়। নইলে অপেক্ষা করে আরও বড় শাস্তি। সালিশির সুলুক-সন্ধানে আনন্দবাজার।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৮ ০২:৪৮
Share: Save:

বর্ষার মেঘে ভরসা নেই!

তবুও গাঁয়ের মাতব্বরেরা দীর্ঘ আলোচনা শেষে ঠিক করলেন, বৃষ্টি নামলে নামবে। বিচার হবে বিকেলের পরেই। তাঁদের যুক্তি, বিচারের জন্য তো আর কাজ কামাই করা যায় না!

মুখে-মুখে গোটা গাঁয়ে কথা রটতে দেরি হল না। ভরসন্ধেয় পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপে থিকথিকে ভিড়। কেউ এসেছেন ছাতা নিয়ে। কারও ব্যাগে ঢাউস পলিথিন। মণ্ডপে জ্বলছে ডুমো বাল্‌ব। তবুও হাতে-হাতে এসেছে বেশ কিছু লণ্ঠন। সেগুলো বাল্‌বের বিকল্প। কারণ, তখন বেলডাঙার সেই প্রত্যন্ত গাঁয়ে লোডশেডিং না হওয়াটাই আশ্চর্যের।

ভিড়ের মধ্যে রয়েছে বছর কুড়ির এক তরুণীও। লন্ঠনের শিখার মতোই সে মাঝেমধ্যেই কেঁপে-কেঁপে উঠছে। তার দিকে সকলের দৃষ্টি। তাকে ঘিরেই ফিসফাস। সে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। একদৃষ্টে। যেন, এখনই পায়ের তলার মাটি দু’ভাগ হয়ে যাবে। সে তলিয়ে যাবে। মিলবে মুক্তি।

কিন্তু মুক্তি কি আর মুখের কথা!

সভায় তখন নানা জনের নানা যুক্তি। প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার মেয়েটি। কখনও ভিড় থেকে ওঠে হাসির হররা। কখনও ছিটকে আসে অকারণ অপমান। গলাটা ঝেড়ে মাতব্বরদের কেউ এক জন বলেন, ‘‘আঃ, এত কথা কেন?’’

এটা প্রশ্ন নয়— ‘অর্ডার’। নিমেষে চুপ চণ্ডীমণ্ডপ।

এ বার ফিসফাস মাতব্বরদের মধ্যে। সকলেই মনে-মনে আঁক কষছেন। কিন্তু কারও হিসেবই জুতসই হচ্ছে না। কারণ, এ বড় জটিল অঙ্ক। বড় কঠিন প্রশ্ন— যৌবনের মেয়াদ কত দিন?

কিন্তু সালিশির অভিধানে অসম্ভব বলে কিছু নেই। মাতব্বরদের এক জন বেশ কিছু সময় পরে জানিয়ে দিলেন, ‘‘এখন মেয়েটির বয়স কুড়ি। আগামী কুড়ি বছরের জন্য ওকে নির্বাসন দেওয়া হল। আমরা ভেবে দেখলাম, চল্লিশের পরেই যৌবন ফুরোবে। তার পরে সে গ্রামে ফিরতে পারে। কারণ, তখন আর ও এমন অপরাধ করতে পারবে না।’’

তরুণী কী ‘অপরাধ’ করেছিলেন?

পড়শি এক যুবকের সঙ্গে কথা বলছিলেন নিজের ঘরে। গ্রামের দুই যুবক তা দেখে ফেলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে থেকে শিকল তুলে খবর দেওয়া হয় গ্রামের অন্য লোকজনকে। আর এই কারণেই থানা নয়, পুলিশ নয়, আদালত নয় গোটা বিষয়টি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিলেন মাতব্বরেরা। বসিয়ে দিলেন
সালিশি সভা।

ওই তরুণীর বিয়ের তিন বছরের মধ্যে স্বামী মারা যান। সন্তান-সংসার নিয়ে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। ঠিক তখনই এমন নিদান।

মেয়েটি গ্রাম ছাড়ে। পরে বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশ মেয়েটিকে গ্রামে ফিরিয়েও আনে। কিন্তু সে ফেরাও বড় সুখের হয়নি।হবেই বা কী করে? কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করে কি আর জলে থাকা যায়?

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Khap Panchayat Law
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE