Advertisement
E-Paper

তোমার যিশুর পাশে আমার যিশু রেখো

আরে, বড়দিনের মেলা তো কী? মেলা তো সবার! যিশুও সবার। তোমার যিশু যে, আমার যিশুও সে। আর, কি নেই সেই মেলায়? পিঠে পুলি থেকে মোমো। জিলিপি, বাদাম, পানের দোকান, প্লাস্টিকের খেলনা, মাটির পুতুল, ঘুঘনি আর ফুচকা। 

সুদীপ ভট্টাচার্য 

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৭:৩০
নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব চিত্র

বিশপ মরো স্কুলের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গির্জার দিকে গিয়েছে, স্কুল পেরিয়ে জোলের পাড়া মাদ্রাসার কাছে বিরাট আলোর গেট, সেখান থেকেই বড়দিনের আলোর শুরু।

আর একটু এগোলেই আর সি পাড়া থেকে শুরু বড়দিনের মেলা—গির্জা ছাড়িয়ে ক্যাথিড্রাল রোডের দু’দিক বরাবর বাঘাডাঙার মোড় পর্যন্ত ছড়ানো। গির্জার মুখ থেকে মেলার আর একটা শাখা গিয়েছে কলেজের দিকের বড় রাস্তা পর্যন্ত।

আলোর গেটের মুখেই সাইকেল, মোটরবাইকের অস্থায়ী স্ট্যান্ড করেছেন মজিত শেখ। সেখান থেকে হাঁটাপথে জোলের পাড়া মসজিদ ছাড়িয়ে খানিক এগোলে আর সি পাড়া উৎসব কমিটির গোশালায় ফাইবারের মডেলে যিশুর জন্ম-কাহিনি। গোশালার এক দিকে মাটির সান্টা ক্লজ। তার পাশে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিমায় সেলফি তোলার হুড়োহুড়ি। মাইকে বারবার ঘোষণা হচ্ছে, ‘যাঁরা সান্টার সাথে সেলফি তুলছেন, দয়া করে রাস্তাটা ছেড়ে দাঁড়ান।’ গোশালা ছাড়ালেই একটা রেস্তোরাঁ— তারস্বরে বাজছে ‘জয় গণেশ, জয় গণেশ, জয় গণেশ দেবা...’।

আরে, বড়দিনের মেলা তো কী? মেলা তো সবার! যিশুও সবার। তোমার যিশু যে, আমার যিশুও সে। আর, কি নেই সেই মেলায়? পিঠে পুলি থেকে মোমো। জিলিপি, বাদাম, পানের দোকান, প্লাস্টিকের খেলনা, মাটির পুতুল, ঘুঘনি আর ফুচকা।

শুধু জিলিপি আর বাদাম খেতে প্রতি বছর বড়দিনের মেলায় আসেন প্রতিমা অধিকারী। শীতে কোমরের ব্যথায় হাঁটতে কষ্ট হয় উনষাট বছরের প্রতিমার। কিন্তু পঁচিশে ডিসেম্বরের রাতে মেলায় আসার লোভ সামলাতে পারেন না। তাঁর কথায়, ‘‘সেই কোন ছোটবেলায় ঠাকুরমার হাত ধরে এই মেলায় আসতাম। দু’পয়সার বাদাম আর দশ পয়সার জিলিপি খেয়ে চার্চের মাঠে বিরাট ক্রিনে যিশুর জীবন নিয়ে সিনেমা দেখতাম। কনকনে শীতের রাতে চাদর জড়িয়ে ঠাকুরমার কোলে বসে যিশুর ক্রুশ বিদ্ধ হওয়া দেখে বাড়ি ফিরতাম।’’

এখন অবশ্য মেলায় আর সিনেমা হয় না। নাতিকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় ঘুরে নানা বায়না মেটাচ্ছিলেন মারিয়া বিশ্বাস। রিমোট কার, কটন ক্যান্ডি, আর মোমো, শেষে গুড়-বাদাম। বয়স হয়েছে তাঁর, ভিড়ভাট্টা ভাল লাগে না, তবু ভাল লাগে এই মেলা। মারিয়ার মনে পড়ে, ‘‘মা বলতেন, তাঁদের ছোটবেলায় আশপাশের গ্রাম থেকে গরুর গাড়ি করে মেলায় আর গির্জায় আসত লোকজন।’’

‘সান্টা টুপি মাত্র কুড়ি টাকা’— ভিড়ের মাঝে টুপি হাতে দাঁড়িয়ে হাঁক দিচ্ছিলেন জাসিন্তা এক্কা। লাল টুপি পরে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার এখন খুব ধুম। এ বছর শুধু পঁচিশের রাতেই দু’হাজার সান্টা টুপি বিক্রি হয়েছে জানিয়ে একগাল হাসলেন জাসিন্তা।

শীতরাতে পিঠে আর পাটিসাপ্টার বিক্রিও নেহাত কম নয়। গৌতম প্রামাণিক এই মেলায় মিষ্টি পান বিক্রি করছেন দশ বছর হল। তিনি বলছেন, ‘‘বারো দোলের পরেই বড়দিনের এ শহরের বড় মেলা বসে। বিক্রিবাটাও ভালই।’’ বাদামের দোকানি পরিতোষ সরকার বলেন, ‘‘বহুদিন ধরে এই মেলায় আসছি। আগে তো কাঠের নাগরদোলা ছিল। এখন সব বিদ্যুতে চলে।’’ খাবারের দোকানও কত রকম— মথুরা কেক, মোমো, রোল, কত কী! কিন্তু মেলায় গরম-গরম বাদামের চাহিদা একটুও কমেনি— জানান পরিতোষ।

কিন্তু মন ভাল নেই বগুলা থেকে আসা জিলিপির দোকানি সুচিত্রা সাহার। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘আগের মতো আর বিক্রি নেই। কেন জানি না! এ কি ব্লাড সুগারের ভয়ে?’’ তবে এ-ও সত্যি, আগের চেয়ে দোকান বেড়েছে অনেক। সব মিলিয়ে বাদাম-জিলিপির বিক্রি বেড়েছে বই কমেনি। মেলা ফিরতি পথে অনেকের হাতেই দেওয়ালে ঝোলানোর মাটির ছোট্ট ক্রুশবিদ্ধ যিশু। সারা দিন পিকনিকের পরে দুই ছেলেমেয়ের আব্দারে মেলা ঘুরে সেই যিশু কিনতে হয়েছে চৌধুরীপাড়ার সোমা মুখোপাধ্যায়কেও। বাড়ি ফেরার পথে তাঁর হাত টেনে ধরে ছোট্ট বুবান বলে ওঠে— ‘‘মা, ঠাকুরঘরে যে দেওয়ালে তোমার ছোটবেলার যিশু ঝোলানো আছে, আমাদের যিশু ঠাকুর দুটোও তার পাশে ঝুলিয়ে দিও, কেমন?’’

Krishnanagar Christmas Day
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy