Advertisement
E-Paper

কর্মীর অভাবে ধুঁকছে বহু গ্রন্থাগার

একটা সময় ছিল যখন নবদ্বীপের পাড়ায় পাড়ায় ছিল পাঠাগার। ছোট-বড় সেই সব পাঠাগারে বেশির ভাগেরই ঠিকানা ছিল স্থানীয় কারও বাড়ির বৈঠকখানা বা রাস্তার ধারের ঘর। এমনকী বহু পাড়ায় ক্লাবঘরেও লাইব্রেরি চলত।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৫৩

একটা সময় ছিল যখন নবদ্বীপের পাড়ায় পাড়ায় ছিল পাঠাগার। ছোট-বড় সেই সব পাঠাগারে বেশির ভাগেরই ঠিকানা ছিল স্থানীয় কারও বাড়ির বৈঠকখানা বা রাস্তার ধারের ঘর। এমনকী বহু পাড়ায় ক্লাবঘরেও লাইব্রেরি চলত।

১৮৮৬ সালে গড়ে ওঠা নবদ্বীপ বঙ্গবিবুধ জননী সভার গ্রন্থাগ্রারটি ছিল সেকালে গোটা বঙ্গদেশের মধ্যে অন্যতম দুর্লভ পুঁথি এবং গ্রন্থের সংগ্রহ। তারও অনেক আগে থেকেই নবদ্বীপের বিভিন্ন নৈয়ায়িক ও স্মার্ত পণ্ডিতদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং বিভিন্ন চতুষ্পাঠীর নিজস্ব সংগ্রহ নিয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয় নগর’ নবদ্বীপের গ্রন্থাগার সংস্কৃতি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখনও দুষ্প্রাপ্য পুঁথি এবং গ্রন্থের বিপুল সংগ্রহ রয়েছে। যার খোঁজে দেশবিদেশ থেকে এখনও গবেষকেরা ছুটে আসেন নবদ্বীপে।

কয়েকশো বছরের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার সংস্কৃতির সেই নবদ্বীপেই ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে গ্রন্থাগার। কয়েক দশক আগেও নবদ্বীপে নয় নয় করে দেড় ডজন পাঠাগার রমরমিয়ে চলত। ১৯০৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগার। নবদ্বীপ শহরের প্রথম আধুনিক গ্রন্থাগার। একশো দশ বছরের সেই সাধারণ গ্রন্থাগার নদিয়া জেলার প্রাচীন পাঠাগারগুলির মধ্যে অন্যতম। তারপর থেকেই নবদ্বীপ নতুন করে যেন পাঠাগার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।

১৯২২ সালে ইয়াং মেনস ইনস্টিটিউশন ছিল পাঠাগারের অন্তরালে গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির আস্তানা। তারপর একে একে ১৯৩০ সালে রমণী স্মৃতি পাঠাগার, ১৯৩২ সালে বঙ্গবাণী বাণীতীর্থ আঞ্চলিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪২ সালে প্রগতি পরিষদ পাঠাগার, ১৯৪৩ সালে অরুণোদয় পাঠাগার, ১৯৫০ সালে নদিয়া ক্লাব পাঠাগার, ১৯৫৩ সালে ফরওয়ার্ড লাইব্রেরি এবং দুর্লভ স্মৃতি পাঠাগার, ১৯৫৪ সালে সৃজনী ক্লাব পাঠাগার, ১৯৫৭ সালে সূর্যোদয় পাঠাগার, ১৯৫৮ সালে রবীন্দ্র পাঠাগার বা ১৯৬৬ সালে নবারুণ পাঠাগারের মতো অসংখ্য পাঠাগার স্থাপিত হয় সারা শহর জুড়ে। ১৯৬২ সালে বিদ্যার্থী মণিমেলা ছোটোদের জন্য পাঠাগার স্থাপন করে। সব মিলিয়ে সে বড় সুখের দিন। বলছিলেন নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব।

নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগারের সম্পাদক নিশীথ বন্দ্যোপাধায় জানান, সে সময়ে নবদ্বীপের ওইসব বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলিকে নিয়মিত বই সরবরাহ করত সাধারণ গ্রন্থাগার। পনেরো দিনের জন্য পঞ্চাশটি করে বই দেওয়া হয়। সামান্য টাকার বিনিময়ে। কিন্তু আটের দশকের শেষের দিক থেকে ছেদ পড়ল সেই ধারাবাহিকতায়। একের পর এক পাঠাগার বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। এখন নবদ্বীপ শহরে হাতে গোনা কয়েকটি গ্রন্থাগার চলে।

নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগার ছাড়াও রয়েছে সরকার পোষিত দুটি গ্রন্থাগার, আদর্শ পাঠাগার এবং বঙ্গবাণী এরিয়া লাইব্রেরি। শিল্পীগোষ্ঠী গ্রন্থাগার এখনও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। টিমটিম করছে প্রগতি পরিষদ বা অরুণোদয় পাঠাগার। কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে বাকি সব। বিধান পাঠাগার, শ্যামলী পাঠাগার, আমাদের পাঠাগার, অরবিন্দ পাঠাগার বা রণেন্দ্র মেমোরিয়ালের নামই এখন অনেকের মনে নেই।

গ্রন্থাগার নিয়ে ছবিটা কমবেশি একই রকম জেলার সর্বত্র। নদিয়া জেলায় সরকার পোষিত গ্রন্থাগারের সংখ্যা এখন ১১০টি। গ্রামীণ বা আঞ্চলিক পাঠাগারের সংখ্যা ৯৯টি। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা এবং গ্রন্থাগারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত স্বদেশ রায় মনে করেন, সেই সব গ্রন্থাগারের ঝা চকচকে ভবন, তাক ভর্তি বই সবই আছে। নেই কেবল পাঠক। কেবল মাত্র গবেষণার কাজে ব্যস্ত, পড়ুয়া ছাড়া এখন আর গ্রন্থাগারে বই খোঁজেন না কেউ। অস্থির অনিশ্চিত জীবন যাপন কেড়ে নিচ্ছে পাঠের অভ্যাস।

তাই কৃষ্ণনগর শহরের বুক থেকে হারিয়ে গিয়েছে সাধনা পাঠাগার কিংবা ভারতী সংসদের মতো ঐতিহ্যশালী গ্রন্থাগার। ধুঁকছে রামকৃষ্ণ পাঠাগার। নদিয়া সীমান্ত সংলগ্ন করিমপুরে ন’টি সরকার পোষিত গ্রন্থাগার থাকলেও নেই গ্রন্থাগারিক। একজনই পালা করে করে বিভিন্ন গ্রন্থাগারের দায়িত্ব সামাল দেন। ফলে বাকি দিনগুলি গ্রন্থাগার খোলাই হয় না। নদিয়া জেলা
গ্রন্থাগার কৃত্যকের সদস্য সম্পদ নারায়ণ বলেন, ‘‘পাঠক আছে, গ্রন্থাগারও আছে। কেবল গ্রন্থাগারের কর্মী সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে গোটা প্রক্রিয়াটাই ব্যহত হচ্ছে।’’

রানাঘাট পাবলিক লাইব্রেরি, মহকুমা পাঠাগার বা নবাঙ্কুর সাধারণ পাঠাগারে ক্রমশ কমছে পাঠকের ভিড়। তবে ছবিটা কিছুটা হলেও উজ্জ্বল কল্যাণীতে। কল্যাণী পাবলিক লাইব্রেরির শুধু পাঠক সংখ্যাই বাড়েনি, প্রতি বছর নিয়ম করে বিভিন্ন সময়ে নামী লেখক কবি গল্পকারেরা এখানে পাঠকের মুখোমুখি হন। রয়েছে তিনটি অপোষিত গ্রন্থাগারও। সেখানেও পাঠকেরা যান।

তবে এ ছবি নিছকই ব্যতিক্রম। গ্রন্থাগার দিবস পালনে যত আগ্রহ বাড়ছে, গ্রন্থাগার থেকে ততই মুখ ফেরাচ্ছে পাঠক। তবে সরকার পোষিত লাইব্রেরির পাশাপাশি অপোষিত গ্রন্থাগারগুলিও যাতে টিকে থাকে সেই জন্য বুধবার সাধারণ গ্রন্থাগার দিবসে জেলার ২৫টি অপোষিত গ্রন্থাগারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার হয়েছে বলে জানান নদিয়া জেলা গ্রন্থাগারিক মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল।

library crisis
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy