Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

এক ফোনেই দিশি-বিলিতি

এক ফোনেই বাজিমাত! টিভি কিংবা খবরেরর কাগজে বিজ্ঞাপনে এমন চমক মাঝেমধ্যেই থাকে। কিন্তু বিশেষ কোনও নম্বরে ফোন করলেই অবিকল ‘কাস্টমার কেয়ার’-এর কেতায় যদি ফোনের ও-প্রান্ত থেকে ভেসে আসে— ‘কী লাগবে, দিশি, রাম, হুইস্কি, বিয়ার...?’

অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র

অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র

অনল আবেদিন ও সামসুদ্দিন বিশ্বাস
বহরমপুর ও কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৬ ০২:৫৪
Share: Save:

এক ফোনেই বাজিমাত!

টিভি কিংবা খবরেরর কাগজে বিজ্ঞাপনে এমন চমক মাঝেমধ্যেই থাকে। কিন্তু বিশেষ কোনও নম্বরে ফোন করলেই অবিকল ‘কাস্টমার কেয়ার’-এর কেতায় যদি ফোনের ও-প্রান্ত থেকে ভেসে আসে— ‘কী লাগবে, দিশি, রাম, হুইস্কি, বিয়ার...?’

নাহ্, দিশির জন্য ১ কিংবা বিয়ারের জন্য # টিপতে হয় না। শুধু বলতে হয় মদের সঙ্গে সঙ্গে কী লাগবে আর কোথায় পৌঁছে দিতে হবে। মদের দাম নির্ধারিত মূল্যের থেকে দশ-পঞ্চাশ টাকা বেশি। ঠান্ডা জল, সোডা, বাদাম-চানাচুর, সিগারেটের দাম আলাদা।

সূর্য পাটে যাওয়ার পরেই দুই জেলা সদর, কৃষ্ণনগর ও বহরমপুরে দিব্যি দৌড়চ্ছে চলমান ‘বার’। ‘কাস্টমার’দের ফোন এলেই দু’ চাকায় ভর করে ছোটাছুটি শুরু হয় শহরের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো। দিনকয়েক আগে কৃষ্ণনগরের শহরের প্রান্তে জলঙ্গির পাড়ে বসেছিলেন জনা চারেক যুবক। সন্ধ্যার নির্জন পরিবেশে ইচ্ছে হল মদ্যপানের। কিন্তু এই ভরসন্ধ্যায় মদ মিলবে কোথায়?

মুচকি হাসছেন একজন, ‘‘তোরা মাইরি সেই মান্ধাতা আমলেই থেকে গেলি। সবুর কর, ফোন করে দিচ্ছি। এখানেই মদ দিয়ে যাবে। কী খাবি তাই বল।’’ সত্যিই তাই। ফোন করার আধঘণ্টার মধ্যেই ঘণ্টি বাজিয়ে হাজির সাইকেল। হ্যান্ডেলের দু’পাশে দু’টো থলে। চালকের পরনে বারমুডা, টিশার্ট। পিঠে স্কুল ব্যাগ।

হাসতে হাসতে বছর চল্লিশের ওই যুবক বলছেন, ‘‘একটু দেরি হয়ে গেল দাদা। খুব চাপ যাচ্ছে কি না। একা হাতে সবদিক সামাল দিতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি।’’ তারপরেই স্কুল ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল রামের বোতল। থলে থেকে ঠান্ডা জল, বাদামের প্যাকেট আর প্লাস্টিকের গ্লাস। তারপর নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে খেতে ‘উল্লাস’!

বহরমপুরের চার তলার ফ্ল্যাটে আবার আর এক কাণ্ড! রাত বারোটা বাজতে না বাজতেই মদ শেষ। রজনী তো এখনও বাকি। কী হবে? মুশকিল আসান করে দিল সেই চলমান বার। দড়িতে বাঁধা থলে সরসর করে নেমে এল নীচে। সঙ্গে টাকা। একই কায়দায় উপরে উঠে গেল মদের বোতল, সোডা। পড়শিরা তো দূরের কথা, কাকপক্ষীতেও টের পেল না! কোনও ঝক্কিএ নেই। ক্রেতারা বলছেন, ‘‘এত সুবিধার পরে সামান্য ক’টা টাকা বেশি দিতে ক্ষতি কী! আপদ-বিপদে, ড্রাই ডে-তে তো ওরাই বড় ভরসা।’’

কলকাতার সানি পার্কে আবেশ দাশগুপ্তের মৃত্যু নিয়ে এখনও হইচই চলছে। মদ নিয়ে উঠে আসছে নানা মতামত। পুলিশের দাবি, বেআইনি মদ বিক্রি বন্ধ করতে ও অল্পবয়সীরা যাতে মদ কিনতে না পারে সে জন্য কঠোর নজরদারিও চলছে। কিন্তু কৃষ্ণনগর ও বহরমপুরে সেই নজরদারির বহর দেখা যায় সন্ধ্যার পরেই।

বহরমপুরের সুনসান ‘মোহনা’ বাস টার্মিনাসে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন চলমান বার মালিক কালু (এই নামেই তিনি পরিচিত)। পুলিশ জানে এই কারবারের কথা? রাতের অন্ধকারে চকিতে চারপাশটা দেখে নিয়ে কালু গর্জে ওঠে, ‘‘জানে না আবার! এখনই বাবুরা জিপ নিয়ে হাজির হবে। তারপর বিনি পয়সায় মদ দাও রে, বাদাম দাও রে, সিগারেট দাও রে। সে কি কম ঝক্কি!’’

ক্ষুব্ধ কালু বলে চলেছেন, ‘‘কিছু বলতে গেলেই থানার বাবুরা আবার বলে, ‘আবগারিকে ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করিস। আর আমাদের গলা ভেজাবি না, তা কি হয় রে?’ অথচ আমি কিন্তু আবগারির শুল্ক দিয়েই তো মদ কিনছি। ফাঁকি দিলাম কোথায়? কিন্তু ও ব্যাটারা কোনও কথাই শুনতে চায় না।’’ কথার মাঝখানেই কালুর ফোন বেজে ওঠে। ঘাড় কাত করে ফোন কানে দিয়েই সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেন কালু, ‘‘দু’টো দিশি তো? এই এলুম বলে। কুড়িটা টাকা বেশি দেবেন। আরে ছি ছি, আপনি কি আমার আজকের কাস্টমার...!’’

আর কৃষ্ণনগরের ওই যুবক কবুল করছেন, ‘‘অভাবের সংসারে দু’পয়সা বাড়তি আয়ের জন্য সন্ধ্যার পরে এই কারবার করি। কাউন্টার থেকে মদ এনেই আমরা বিক্রি করি। মাইরি বলছি, আমার কাছে কোনও ভেজাল পাবেন না। কমবয়সীদেরও আমরা মদ বিক্রি করি না।’’ আবগারি দফতরের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, খুচরো ভাবে ক্রেতাদের এক সঙ্গে ১২ লিটার দিশি মদ ও ৩৬ লিটার বিলিতি মদ বিক্রির নির্দেশিকা রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ মদ বিক্রেতারা এই সুবিধাটাই নিচ্ছেন।

পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে নদিয়ার জেলাশাসক সুমিত গুপ্তা বলেন, ‘‘বেআইনি ওই মদ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ মুর্শিদাবাদ জেলা আবগারি দফতররে সুপার দেবাশিস বিশ্বাস বলছেন, ‘‘সম্প্রতি ফরাক্কায় মোটরবাইক- সহ এমনই এক মদ বিক্রেতাকে পাকড়াও করেছি।’’

তারপরেও অবশ্য ছুটি নেই কালুদের। সন্ধ্যার পরে সাইকেলের ঘণ্টি বেজেই চলেছে। কখনও আলো-আঁধারি মাঠে, কখনও ও-পাড়ার ফ্ল্যাটে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Alcohol phone call
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE