Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Christmas

করোনার আঁধারে ঢেকেছে বড়দিনের রোশনাই

সব ঘরে জ্বলবে না আলোর রোশনাই। ভেসে আসবে না সুস্বাদু খাবারের গন্ধ। কারণ, এবার যে করোনা কেড়ে নিয়েছে অনেকের জীবিকা।

সান্তা টুপি বিক্রি। কৃষ্ণনগরের বইমেলায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

সান্তা টুপি বিক্রি। কৃষ্ণনগরের বইমেলায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

সুস্মিত হালদার 
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:৫০
Share: Save:

করোনার আঁধারে ঢেকেছে বড়দিনের রোশনাই। ধুম জ্বর এসেছিল মেয়েটির। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সবাই। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। মাস চারেক আগে সে সবাইকে ছেড়ে চলে যায়। বাবাকে একটিবার দেখতে চেয়েছিল। দেখতে পায়নি। কারণ, সুদূর দুবাই থেকে বাবা ফিরতে পারেননি বাড়িতে। মেয়েকেও শেষবারের মতো দেখতে পাননি মিঠুন মণ্ডল। বড়দিনের আগে আর এক মেয়ে তাঁকে কাছে পাওয়ার জন্য বায়না করছে। এবারও তিনি আসতে পারেননি।

কী করেই বা আসবেন? করোনার কারণে দুবাইয়েও অবস্থা খারাপ। সেখানে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। আগের সংস্থা ঠিক মতো বেতন দিতে পারছিল না। বাধ্য হয়েই দৈনিক মজুরির শর্তে অন্য একটা সংস্থায় কাজ নিয়েছেন। সেখানেও প্রায় একই অবস্থা। মাসে ১০-১২ দিনের বেশি কাজ নেই। সামান্য যে ক’টা টাকা আয় হচ্ছে, তাতে নিজের থাকা খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে তেমন কিছুই হাতে থাকছে না। বাড়ি ফেরার বিমান ভাড়া জোগাড় করে উঠতে পারেননি তিনি। তাই ফিরে আসা তো দূরের কথা, বড়দিন পালনের জন্য সামান্য কিছু টাকাও পাঠাতে পারেননি। বছর চারেকের ছোট মেয়েটিকে নিয়ে চাপড়ার রানাবন্ধে বাপেরবাড়িতে এসে উঠেছেন স্ত্রী মামনি মণ্ডল। তিনি বলেন, “বড়দিনের উৎসব পালনের কথা ভাবতেই পারছি না। মেয়েটাকে নিয়ে বাপেরবাড়িতে এসে উঠেছি দু’মুঠো খেয়ে বাঁচব বলে।”

বড়দিন এলেই উৎসবের মেজাজে মেতে ওঠে কৃষ্ণনগরের আর সি পাড়া। এখানেই মূলত খ্রিস্টান ধর্মের মানুষের বাস। গোটা এলাকা চুড়া মেলা বলে। শহরের মানুষ ভিড় করেন সেই মেলায়। যাঁরা বাইরে কাজে যান, তাঁরা প্রায় সকলেই ফিরে আসেন এই সময়। ঘরে ঘরে কেক তৈরির ধুম। আলোর রোশনাই। নতুন কাপড়। নানা পদের খাবারের আয়োজন হয় প্রতিটা বাড়িতে। অন্য ধর্মের পরিচিতদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এমনটাই হয়ে আসছে বছরের পর বছর। এমনটাই দেখে আসতে অভ্যস্ত শহরের মানুষ। কিন্তু এবার যেন সবেতেই তাল কেটে যাচ্ছে প্রতি পদে। করোনার কারণে মেলা বসবে না এবার। সব ঘরে জ্বলবে না আলোর রোশনাই। ভেসে আসবে না সুস্বাদু খাবারের গন্ধ। কারণ, এবার যে করোনা কেড়ে নিয়েছে অনেকের জীবিকা। অনেকেই প্রায় কর্মহীন। বিদেশে কর্মস্থান থেকে বাড়ি ফিরতে পারেন নি যে অনেকেই।

যেমন দুবাই থেকে ফিরতে পারেননি সৌরভ সরকার। প্রায় পাঁচ মাস কাজ হারিয়ে সেখানে বসে আছেন। সামান্য যা সঞ্চয় ছিল, সেটা ভাঙিয়েই কোনও মতে সেখানে রয়ে গিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার কাজ পাবেন এই আশায়। আর সি পাড়ার বাড়িতে তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী এবং বছর দুয়েকের সন্তান। ছেলে টাকা পাঠাতে পারেননি। তাই উৎসব মলিন এই বাড়িতে। যেটুকু না হলে নয়, সেটারই আয়োজন করা হচ্ছে। সৌরভের বাবা প্রতাপ সরকার বলেন, “এবার আর কেক বানানো হবে না। জীবনে যে এমন দিন আসবে সেটা কোনও দিন কল্পনাও করতে পারিনি। চারদিকটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আছে।”

প্রায় একই অবস্থা মূর্তি শিল্পী সত্যজিৎ বিশ্বাসের। তিনি ঝাঁসিতে থেকে মূর্তি তৈরির কাজ করতেন। লকডাউনের সময় বাড়ি ফিরে এসেছেন। এখানে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আর ফেরা হয়নি। তাছাড়া সেখানেও তেমন কাজ নেই। বাড়িতে কিছু জিশু খ্রিস্ট, মাতা মেরির মূর্তি তৈরি করে রেখেছেন। মেলায় বিক্রি করবেন বলে। কিন্তু মেলাটাও এবার বন্ধ। সত্যজিৎ বলেন, “ভেবেছিলাম মেলায় কিছু মূর্তি বিক্রি করে সেই টাকায় বড়দিনের খরচা তুলব। কিন্তু সেটাও হল না।”

কম বেশি একই অবস্থা প্রায় সকলেরই। সকলের মনেই যেন বিষণ্ণতা। সকলেই যেন বড়দিনের আলোর রোশনাইয়ের মাঝে জীবনের আলো খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Christmas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE