কার্তিক পূর্ণিমার রাত বৈষ্ণবদের বড় প্রিয়। এ রাতেই তাঁদের প্রাণের উৎসব, রাস উদ্যাপিত হয়। তাই ভজনকুটিরের নিকোনো উঠোনে আলপনা, উঠোনের একটা কোনে টাঙানো হয়েছে ছোট্ট একখানি চাঁদোয়া। তার নীচে রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। বড় মায়াময় সে মূর্তি। উঠোনের এক কোণে মঞ্জরীভরা তুলসী গাছের ঝাড়। কার্তিকের জ্যোৎস্নার দুধ-সাদা আলোয় ভজনাশ্রমের চেনা পরিবেশ কেমন যেন অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে। কাঠের ছোট সিংহাসনে বসানো যুগলবিগ্রহের চারপাশে গোল করে সাজানো অষ্টসখীর মূর্তি। পরনে জমকালো পোশাক। সামনে ফরাস পাতা। তাতে সাজানো মৃদঙ্গ, মন্দিরা, হারমোনিয়াম, করতাল এবং আড়বাঁশি। সুগন্ধী ধূপ, আতর এবং ফুলের গন্ধে ম ম করে চারপাশ।
বলা হয় রস থেকে রাস। বৈষ্ণব দর্শনে বলা হয় পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের ঘনীভুত আধার। তাঁকে ঘিরে যে উৎসব তাই রাসোৎসব। বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটি অন্য অর্থ বহন করে। রাস পূর্ণিমার রাতে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের যমুনার তীরে গোপীনিদের আহ্বান করেন এবং তাঁদের অহংবর্জিত বিশুদ্ধ ভক্তি ভাবে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস ভক্তের সঙ্গে ভগবানের মিলন উৎসব। ভজনকুঠিরের নিভৃত কোনে হেমন্তের জ্যোৎস্না ভেজা রাতে ইষ্টের সঙ্গে ভক্তের মিলনেই রাসের সার্থকতা। সন্ধ্যারতি শেষ হতেই মাঝবয়েসি ভক্ত বিগ্রহের দিকে হাতজোড় করে প্রণাম করে তুলে নিলেন আড়বাঁশিটি। তিলক মাটিতে আঁকা রসকলি নাকের তীক্ষ্ণ ডগা থেকে উঠে গিয়েছে প্রশস্ত কপাল পর্যন্ত। গভীর শান্ত চোখ দুটি বুজে আলতো ফুঁয়ে ধরলেন রাগ ‘কেদার’। সেই শান্ত হেমন্ত সন্ধ্যায় বাঁশির সুর ভজনকুটিরের উঠোন ছাড়িয়ে ভেসে যেতে লাগল সুরধনী গঙ্গার দিকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঁদ হয়ে উঠছে রাস পূর্ণিমার রাত। ভিড় বাড়ছে আসরে। এ বার বাঁশির সঙ্গে ‘নিখুঁত কণ্ঠ’ মিলিয়ে বৈষ্ণবী গেয়ে উঠলেন মহাজনপদ— “কাঞ্চন মনিগণ, জনু নিরমাওল, রমণীমণ্ডল সাজ। মাঝহি মাঝ, মহামরকত সম, শ্যামর নটবর রাজ। ধনি ধনি অপরূপ রাসবিহার। থির বিজুরি সঞে, চঞ্চল জলধর, রস বরিখয়ে অনিবার।” জোড়া মৃদঙ্গে বেজে উঠল ‘দশকুশি’।
বৈষ্ণব ভজনকুটির বা আখড়াগুলিতে এ ভাবেই পালিত হয় রাস। বৈষ্ণব দর্শন রাসের যে ব্যাখ্যাই করুক। বৈষ্ণব আখড়ায় যে ভাবেই রাস পালিত হোক না কেন। চৈতন্যধাম নবদ্বীপে কিন্তু রাস আসে সম্পূর্ণ অন্য রূপে। পূর্ণিমার ভরা চাঁদের রাতে বিশুদ্ধ তন্ত্র মতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো। সঙ্গে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা উৎসবের এক উচ্চকিত দামাল উদ্যাপন। রাস পূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে বিচিত্র রূপের শক্তি মূর্তিরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। যে জন্য অনেকে নবদ্বীপের রাসকে শাক্তরাস বলে থাকেন।