রথযাত্রায় উপচে পড়ছে ভিড় ইস্কনে। — ফাইল চিত্র
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বর্ষা এল মানেই উৎসবের শুরু। শুরুটা হয় গঙ্গাপুজো দিয়ে। তার পর গোটা বর্ষাকাল জুড়ে একের পর এক বৈষ্ণবীয় পার্বণ। স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, জন্মাষ্টমী। উৎসবের যেন শেষ নেই।
আসলে একটা সময়ে বর্ষা ছিল বড় দুর্ভোগের ঋতু। দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য দেশের অধিকাংশ অঞ্চল অপর অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটায়’ দুর্গম পথঘাট মনুষ্য চলাচলের অযোগ্য হয়ে উঠত। পণ্ডিতেরা বলেন সে কালের বর্ষা মানুষকে অন্তর্মুখী করে তুলত। সাধক বৈষ্ণব এ সময় ভজনকুঠির চার দেওয়ালের নির্জনতায় মুখোমুখি হতেন ইষ্টদেবতার। মেঘমল্লারে পদ রচনা করতেন পদকর্তারা। বৈষ্ণবকবি শোনালেন অঝোর বৃষ্টির রাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের কথা। শোনালেন বর্ষারাতে শ্রীরাধার সঙ্গে অভিসারের কথা। তখন প্রতি দিনই প্রাণবল্লভের সঙ্গে ভক্তের উৎসব।
তার পর এক সময় বদলে গেল সব কিছু। গভীর নির্জনের উৎসব হয়ে উঠল সকলের। মেঘে ঢাকা আকাশে মানুষ ঘরে না থেকে বেরিয়ে পড়লেন। পিচঢালা রাজপথ ধরে ছুটল গাড়ি। গন্তব্য কোন বৈষ্ণবতীর্থ। হতে পারে সেটা পুরী কিংবা বৃন্দাবন। নবদ্বীপ কিংবা মায়াপুর। মেঘমেদুর আষাঢ় পড়তেই উৎসবে মেতে উতছে নদীর দু’পাড়। নবদ্বীপ এবং মায়াপুর প্রস্তুতি নিচ্ছে বর্ষা-উৎসবের। পর্যটন নির্ভর নবদ্বীপের অর্থনীতিতে রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, এমনকী ঝুলনের মতো উৎসবও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন একটা সময়ে বর্ষাকাল মানেই ছিল চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকার কাল। কিন্তু এখন তেমনটা হয়না। বর্ষাকাল জুড়ে কিছু না কিছু উৎসব লেগেই থাকে। পর্যটকেরা সেই সব উৎসবে অংশ নিতে আসছেন। আর বহিরাগত মানুষ আসা মানেই স্থানীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়া।
নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, “আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি রথে মানুষ পুরি যাচ্ছেন। কিন্তু ইস্কনের রথ দেখতে এত মানুষের ভিড় হবে তা কে জানত। আসলে মানুষ এখন আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে অংশ নিচ্ছেন। তার সুফল কিছুটা হলেও পাচ্ছেন সেই সব এলাকার ব্যবসায়ীরা। উৎসবের টানে ঘোর বর্ষাকালেও (একদা যাকে ‘অফ সিজন’ বলা হতো) বাড়ছে পর্যটকের ভিড়।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ‘ফেডারেশন অফ বেঙ্গল হোটেলিয়ার্স’-এর রাজ্য সম্পাদক প্রসেনজিৎ সরকার জানান, গত কয়েক বছরে মানুষের মানসিকতার আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। শুধু তীর্থ করতে আসছেন এমন নয়। শুধু রথের দড়ি টানতে বা ঝুলন, জন্মাষ্টমী উদযাপন করতে নয়। অনেকে আসছেন সপ্তাহান্তে নিছক বর্ষাকাল উপভোগ করতে। তিনি বলেন, “একটা সময় ছিল যখন মানুষ দার্জিলিং যেত গরম কালে। এখন লোকে বেশি করে শীতকালে পাহাড়ে যায় বরফ দেখবে বলে। প্রচণ্ড বর্ষায় সমুদ্র দেখতে কেমন লাগে তাতে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। ফলে ‘অফ সিজন’ কথাটা পর্যটনের ক্ষেত্রে ক্রমশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে।”
কলকাতা-সহ শহুরে মানুষ বর্ষায় নবদ্বীপ মায়াপুরে আসছেন গঙ্গা জলঙ্গির সঙ্গম দেখতে। প্রসেনজিৎবাবুর কথায়, “বর্ষার নদীর টাটকা মাছ খাওয়ার জন্য হোটেল বুকিং হচ্ছে এখন। তাঁরা আসার আগে জেনে নিচ্ছেন এ বার নদীর মাছ কেমন উঠছে। সব মিলিয়ে বর্ষার পর্যটন ধারণটাই অন্য রকম হয়ে উঠছে।”
তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মনে করেন নবদ্বীপ মায়াপুরের পর্যটন থেকে আরও বড় আকারে আর্থিক সুবিধা পেতে হলে পরিকাঠামোর অনেক কিছু বদলাতে হবে। যেমন কৃষ্ণনগরে হাতে গোনা খানদুয়েক বড় হোটেল ছাড়া ভালো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। যে কারণে উচ্চবিত্ত পর্যটকের যাতায়াত তুলনায় কম এখানে। দরকার ভাল মানের একাধিক হোটেল বা অতিথিশালা নির্মাণ। দ্বিতীয়ত, নবদ্বীপে ট্রেন যোগাযোগ থাকলেও মায়াপুরে রেলপথ নেই। কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত রেল যোগাযোগের নতুন ব্রডগেজ লাইন মহেশগঞ্জের কাছে এসে
সেই যে থমকে গেল, আর তা এগোল না। অন্য দিকে সড়ক পথে মায়াপুর যেতে দরকার একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তা। এখন কৃষ্ণনগর ঘুরে ধুবুলিয়া হয়ে মায়াপুর যেতে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ বা বর্ধমান থেকে যাঁরা গৌরাঙ্গ সেতু পেরিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রেও মহেশগঞ্জ দিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত পথ রয়েছে যে পথে পঁচিশ থেকে তিরিশ কিলোমিটার কম অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু এ নিয়ে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
যদি এই সব পরিকাঠামোগত খামতি মিটিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে বারো মাসে তেরো পার্বণের এই অঞ্চলে লক্ষ্মী বাঁধা থাকবেন বর্ষা
থেকে বসন্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy