বাজারে আগুন দাম শীতের মাছের। — ফাইল চিত্র।
শীত ফুরোতে চলল। তবে বাজারে এ বার সে ভাবে মিলল না শীতের মাছ। এমন কিছু মাছ আছে যা প্রধানত শীতকালেই মেলে। নলেন গুড়, কমলালেবু, খেজুর রস বা ফুলকপির সিঙাড়ার আবডালে থাকা শীতকালীন সে সব মাছের খবর ভোজনরসিক মাত্রেই রাখেন। অপেক্ষায় থাকেন শীতের কই, বেলে, শোল, ল্যাঠা বা দেশি মাগুরের। গভীর জলের সেই সব মাছের হদিশ শীতের মরসুমে খাল, বিল, পুকুরের জলে টান ধরলে তবেই পাওয়া যায়।
তবে শীতের মাছের জোগান ভীষণই অল্প। বিক্রেতারা অল্পস্বল্প যা নিয়ে আসছেন তার দাম শুনে প্রবল শীতেও ঘামছেন ক্রেতা। শীতকালীন মাছের দাম এ বার কেজি পিছু ২০০টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্বিগুণ দরে বিকিয়েছে সে সব মাছ।
কই, দেশি মাগুর বা ট্যাংরা মাছের দাম কেজি পিছু এবার প্রায় ৪০০ টাকা বেশি। অন্যদিকে কাজুলি, শিঙি মাছের দর কেজি পিছু কমবেশি ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রিঠা কিংবা আর মাছের ১৫০ টাকা গড়ে বেড়েছে। ল্যাঠা, মৌরলা ৭৫-১০০ টাকা প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে। শীতের অন্যতম আকর্ষণ বেলে গুড়গুড়ি মাছ এখনও পর্যন্ত সেভাবে বাজারেই আসেনি। বিক্রেতারা জানাচ্ছেন আর আসার সম্ভবনা নেই।
জেলার বিভিন্ন এলাকার মাছ ব্যবসায়ীরা এ জন্য দায়ী করছেন এ বারের অপর্যাপ্ত বর্ষাকে। এই বছর প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে খাল, বিল, ডোবা বা পুকুরের মতো জলাশয়গুলিতে ওই সব দেশীয় মাছের স্বাভাবিক প্রজননের হার প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। সাধারণ ভাবে পৌষ-মাঘ মাসে জলাশয়গুলিতে জল কমে গেলে ওই মাছের জোগান বাড়ে। তবে এ বারে বর্ষা না-হওয়ায় সেই পরিস্থিতি তৈরিই হয়নি।
নবদ্বীপের মাছ ব্যবসায়ী বাদল হালদার বলেন, “এ সময় যে সব মাছ বেশি পাওয়া যায় তাঁদের দাম এ বার খুবই বেশি। মাগুর ৮০০-৯০০ টাকা কেজি, কই ৭০০-৮০০ টাকা, শিঙি ৭০০-৮০০ টাকা। গত বারে দাম প্রায় অর্ধেক ছিল। এ বার বেলে মাছ এখনও এক দিনও পাইনি। রিঠা, আর, কাজুলি, ট্যাংরা, ভেদা, পুঁটি সব মাছের একই অবস্থা।”
মাছের পাইকারদের কথায় গতবারে ভাল বৃষ্টি হয়ে ছিল। তাই দেশি মাছের জোগান ছিল ভাল। এ বারে বর্ষা হয়নি তাই খাল-বিলের দেশি মাছ খুব কম। এই প্রসঙ্গে পাইকারি ব্যবসায়ী তন্ময় দত্ত বলেন, “এখন মাছ বাজারের ভরসা প্রধানত চাষের মাছ। অন্ধ্র বা বিলাসপুরের পাশাপাশি এ রাজ্যে উৎপন্ন রুই, কাতলার সঙ্গে বাটা বা পুরুলিয়ার আর মাছই চাহিদা মেটাচ্ছে বাজারের।”
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন মাগুরের মতো কিছু মাছের কৃত্রিম প্রজনন হলেও বেশির ভাগ শীতকালীন মাছই বর্ষায় উপযুক্ত পরিবেশে স্বাভাবিক ভাবে বংশবিস্তার করে। এ বারে বর্ষা না হওয়ায় সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। তেমনই কিছু রাসায়নিকেরও ভূমিকা আছে মাছ না পাওয়ার পিছনে। মৎস্য বিশেষজ্ঞ তথা সিঙ্গুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান দেবজ্যোতি চক্রবর্তী বলেন, “ব্যবসায়ীরা লাভের কথা ভেবে নির্বিচারে অর্গ্যানো ফসফরাস, রোটেনন, ব্লিচিং পাউডার-সহ নানা অ্যান্টি বায়োটিকের ব্যবহার করছেন। যা দেশীয় মাছের প্রজাতিকে দ্রুত নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে।”
কোনও রাসায়নিক মাছের স্নায়ুতন্ত্র শিথিল করে দেয়, হয়ে ঝিমিয়ে যায়। যেখানে বাণিজ্যিক মাছের চাষ হয় সেখানে বাকি মাছ মারতে ব্লিচ করা হয়। চাঁদা জাতীয় মাছ মারতে এমন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় যাতে মাছ মরে তলিয়ে যায় ভেসে ওঠে না। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা শুধু এবছর বলে নয় যত দিন যাবে ততই হারিয়ে যাবে ওই সব দেশি মাছ। এখনই সরকারি ভাবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের মতো সতর্কতা না-নিলে বাঙালির মৎস্যহীন পাত নাকি শুধু সময়ের অপেক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy