সরকারি অনুষ্ঠান হলেই দেখা যায়, সেখানে হাজির শাসকদলের ব্লক সভাপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদের নেতারা। মাইকে ঘোষণা করে পরিচিতি করানো হয়, তিনি সমাজ সেবক। কিন্তু সেখানে বিশেষ করে ক্ষমতার নিরিখে শাসকদলের পদাধিকারী কিংবা রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি বানিয়ে সমাজসেবক আখ্যা দিয়ে বরণ করা হয়। এই ধরনের ঘটনা দেখে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার বেশ কিছু মানুষ।
স্থানীয় মানুষদের বক্তব্য, বর্তমান শাসকদল বলে কথা নেই, বিগতদিনে বাম জামানাতেও তারা এমনটি দেখেছেন। যেমন বাম আমলে জোনাল কমিটি, লোকাল কমিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদের ব্যক্তিত্বদের থানাতে পুলিশের অনুষ্ঠান কিংবা ব্লক অফিসে নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হলে তাদের উপস্থিতিতে পরিচিতি পর্বে সমাজসেবক আখ্যা দেওয়া হত। সেই ট্রাডিশন এখনও চলছে। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে বাম জামানার সেই ট্রাডিশন প্রশাসনে এখনও বর্তমান। শুধু সরকারি অনুষ্ঠান বলে কথা নয়, খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও সমাজসেবক হিসেবে তাদের উপস্থিতি তুলে ধরা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আনন্দপল্লির বাসিন্দা পেশায় উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী অরুণ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক পরিচিত পাওয়া ব্যক্তিত্ব মানুষদের বিশেষ করে শাসকদলের ক্ষেত্রে সরকারি যে কোনও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, থানাতে বস্ত্রবিতরণ, রক্তদান শিবির থেকে শুরু করে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি কিংবা বিগত দিনে সিপিএমের জোনাল কমিটির সম্পাদককে সমাজসেবী হিসেবে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এক কথায় এই ধরনের সমাজসেবী আখ্যা শুনতে কানে লাগে। রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ্যে বলতে অসুবিধাটা কোথায়?’’
সিপিএমের করিমপুর ১ এরিয়া কমিটির সম্পাদক সন্দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলের পদকে আড়াল করে সমাজসেবক আখ্যা দেওয়াটা ঠিক নয়। এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে।’’ কিন্তু বাম আমলেও তো একই ভাবে এমনটাই ঘটতো। সন্দীপকের সাফ জবাব, ‘‘সে সময়েও ভাবনাতে ভুল ছিল।’’
বিজেপির মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলার সহ-সভাপতি সুরজিৎ জোয়ার্দার বলেন, ‘‘আমাদের তো অনুষ্ঠানে ডাকাই হয় না। তবে কর্মীদের মাধ্যমে খোঁজখবর পাই। সিপিএমের এরিয়া কমিটি সম্পাদককে আগে ডাকা হত। এখন তৃণমূলের ব্লক সভাপতিকে ডেকে পুলিশ কিংবা প্রশাসনের নানা অনুষ্ঠানে সমাজসেবক বলে চেয়ারে বসানো হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সরাসরি রাজনৈতিক পরিচিতি দিলে অসুবিধা কোথায় আমরা তো বুঝতে পারি না।’’ এমন ঘটনা তো বিজেপি শাসিত রাজ্যেও হয়ে থাকে প্রশ্ন করলে সুরজিতের দাবি, এই পদ্ধতিই ত্রুটিপূর্ণ।
করিমপুরের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক সঞ্জিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় রাজনৈতিক নেতা দ্বারা শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত। সেখানে এক জন ব্যক্তি তার সেই রাজনৈতিক পরিচিতি নিয়ে প্রশাসনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন কিংবা আমন্ত্রণ পেয়ে যান। এ ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচিতির কথা বলাই ভাল। আড়াল করার বিষয়টি কিন্তু সবাই বোঝে।’’
তৃণমূলের করিমপুর ১ ব্লক সভাপতি আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন থেকেই এই ট্র্যাডিশন চলে আসছে, ভুল না ঠিক জানি না। আমি সোজাসাপ্টা বলতে চাই, বাম আমল থেকে এই সময়, সরকারি অনুষ্ঠানে সাধারণত শাসকদলের নেতারাই আমন্ত্রণ পান। কিন্তু দর্শক আসনে যারা বসে থাকেন, তাঁরা বিভিন্ন দলের থাকেন। শুধুমাত্র শাসকদলের পদের পরিচিতি বললে, সেটা দৃষ্টিকটু লাগে। যে কারণে আমাদের সমাজ সেবক বলা হয়।’’
করিমপুরের তৃণমূল বিধায়ক বিমলেন্দু সিংহ রায় বলেন, ‘‘আমি তো তৃণমূল দলের প্রতীকের জিতে বিধায়ক হয়েছি। এটাও তো একটা রাজনৈতিক পরিচিতি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বিধায়ক হওয়ার পরে প্রথম প্রথম সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখতাম দলের ব্লক সভাপতিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের সমাজসেবক বলে বিশেষ আসনে বসানো হচ্ছে। মাইকে যখন ঘোষণা করা হতো তখন আমার খটকা লাগতো। তবে এখন এটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)