চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার দু’হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। অথচ গাড়ির আলো জ্বালানোর উপায় নেই। কারণ, যুদ্ধ চলাকালীন এয়ার বেসে আলো জ্বালানো চলবে না। শত্রুপক্ষ সেই আলো দেখে আঘাত করতে পারে। ফলে আন্দাজেই গাড়ি চালাতে হচ্ছে চালককে। রাতের অন্ধকারেই জ্বালানী ভরে আকাশে উড়ে যাচ্ছে দুয়েকটা যুদ্ধ বিমান। যুদ্ধের সামগ্রী নিতে নামছে বোমারু বিমানগুলি। সেই মুহুর্তে ঝলসে ওঠা আলোতেই চারপাশটা দেখে নিতে হচ্ছে। কাশ্মীরের অবন্তিপুরা এয়ার বেসে যাতে শত্রুপক্ষ কোনওভাবে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য সদা সর্বদা কড়া প্রহরায় আছেন সেনাকর্মীরা। চারপাশটা ঘিরে রেখেছেন তাঁরা। নিশ্চিদ্র প্রহরায় ঘেরা।
রাতে টহলে বেরিয়েছেন বিমান বাহিনীর স্টোয়াড্রন লিডার রঞ্জন মুখোপাধ্যায়। আছেন কমান্ডিং অফিসারও। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে বেড়িয়েছেন তাঁরা। প্রহরারত জওয়ানদের সঙ্গে কথা বলছেন। তাদের খোঁজ খবর করছেন। ওদিকে ওপারেশন রুমে (অফিস রুম) মনিটরে সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছেন বিমান বাহিনীর কর্মীরা। সাদা সক্রিয় সক্রিয় মিশাইল নেটওয়ার্ক-র্যাডার নেট নেটওয়ার্ক।
হঠাৎ ধেয়ে আসা মিশাইল আক্রমণ রুখে দেওয়ার জন্য। ক্লান্তিতে চোখ জুড়িয়ে আসছে। কিন্তু কোনওভাবেই অসতর্ক হওয়া যাবে না। বর্তমান যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কার্গিল যুদ্ধের সময় সেই মুহুর্তগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের। বলছেন, “যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় সাত দিন আগেই আমাদেরকে অবন্তিপুরা এয়ার বেসে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ছিলাম। সমস্ত ধরনের আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হত। প্রতিটা মুহুর্ত ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনওভাবেই অসতর্ক হওয়া চলবে না।”
তাঁর ‘পোস্টিং’ ছিল নাসিকে। বেশ কিছু দিন আগে থেকেই যুদ্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। দিন সাতেক আগে তাদের উড়িয়ে আনা হয় কাশ্মীরের আবন্তিপুরায়। কার্গিলের যুদ্ধ তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছে। স্থল বাহিনীর পাশাপাশি বিমান বহিনীর সক্রিয়তাও তখন চরম পর্যায়ে। এসার বেসে একের পর এক যুদ্ধ বিমান নামছে। কেই জ্বালানি ভরছে তো কেউ যুদ্ধের সরঞ্জাম নিয়ে আবার উড়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। ২৪ ঘণ্টাই চরম ব্যস্ততা।
রঞ্জন বলেন, “কোনও কিছুই তো আগে থেকে নির্দিষ্ট করা নেই। সবই হঠাৎ হঠাৎ। খবু বেশি হলে দশ-পনের মিনিট আগে জানা যাচ্ছে কোন বিমান নামছে আর তার কী প্রয়োজন। ফলে বিশ্রাম নেওয়া বা অসতর্ক হওয়ার উপায় নেই কারও।” তিনি বলেন, “আমাদের দায়িত্ব ছিল সমস্ত কিছুর আয়োজন করা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হত। তাছাড়া সেনাদের মনবল অটুর রাখার কাজটাও করতে হত। কারণ, যুদ্ধের সময় বিশ্রাম আর মনবল অটুট রাখাটা হত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
২০২৩ সালে তিনি বিমান বাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য নিজের বাহিনীকে ভুলে থাকতে পারে না। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মনে পড়ছে কার্গিল যুদ্ধের সেই সমস্ত দিনের কথা। যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বলেন, “জয় তো হয়েই গিয়েছে। পাকিস্থানের তো এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ওরা ভারতের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)