একটু আগেই থেমেছে ঝড়টা। গাছাগাছালি ভরা গাঁয়ের বাড়ির উঠোন-বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে কাঁচা-পাকা আম।
অন্য সময়ে হলে হয়তো ঝড়ের মধ্যেই হামলে পড়ত ছেলেছোকরার দল। কিন্ত, কে তাকাবে সে দিকে? গোটা গ্রাম ভিড় করেছে সাদামাটা একতলা বাড়িটার উঠোনে, দরজার বাইরে গুমরোচ্ছ জটলা।
এ গ্রামে হচ্ছেটা কী?
মোটে এক সপ্তাহ আগেই গ্রামের মেধাবী ছাত্র, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সাগর মণ্ডলের ঝুলন্ত দেহ মিলেছে শৌচাগারে। তাঁকে খুন করা হয়েছে, এই দাবি তুলে অবরোধ করেছিলেন গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো। সৌমিত্রও ছিল সেই দলে। তার পর সে-ও...
গত ক’দিন ধরে প্রাণপণে ছন্দে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছিল গ্রামটা। কিন্তু আবারও একটা ঝড় লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল সব। সেই সাগরেরই অপমৃত্যুর শোক সহ্য করতে না পেরে বিষে নীল হয়ে গেল তারই স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সৌমিত্র ঢালি।
পরপর দু’টো তরতাজা প্রাণ!
এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকেই। তার মধ্যে সাগরের বাবা সুশান্ত মণ্ডল, দিদি রেখা মণ্ডলেরা আছেন। খবরটা পাওয়ার পর থেকে দু’বার সৌমিত্রের বাড়ি ঘুরে এসেছেন সুশান্তবাবু। মঙ্গলবার বিকেলে পাড়ার মোড়ে যখন সৌমিত্রের দেহ নামানো হল, গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ল। সেই ভিড়ে মিশে থাকলেন রেখাও।
ছেলেছোকরাদের মড়ক লেগেছে নাকি এ গাঁয়ে?
সোমবার সৌমিত্রর খবর জানা ইস্তক এ কথাই জিজ্ঞেস করছেন বহু গ্রামবাসী একে-অন্যকে। মাঝবয়সী স্কুলশিক্ষক সমীরণ সরকার বলছেন, ‘‘খুব ভয় করছে, জানেন! আবার যদি এ রকম কিছু ঘটে! ছেলেগুলো যে কী আঘাতে এ রকম ভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেটাই তো আমরা বুঝতে পারছি না। ওরা কে যে কখন কী করে বসবে, সেই ভয়েই আমরা কাঁটা।’’
রাস্তায় কমবয়সী যাকেই দেখছেন, ভাল করে নজর দুই কিশোরীর মা মিতালি দেবনাথ।। বললেন, ‘‘ওরা কত কী ভাবে নিজেদের মতো, সব তো আমাদের বলে না। তাই নজর রাখছি, চোখমুখের অবস্থা দেখে যদি আগাম কিছু বোঝা যায়!’’
পাড়ার মাঠে মনমরা হয়ে বসেছিল কচিকাঁচাদের দল। তাদেরই এক জন বলল, ‘‘এই মাঠে পুজোর প্যান্ডেল হয়, জানেন। সব কিছুতেই ডাক পড়ত সৌমিত্রর। বড্ড ভাল ছিল ছেলেটা।’’ মাঠেই এক জন খবরের কাগজ নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ছেলেদের খেলার খবর পড়ে শোনান রোজ। আজ আর কারও শোনার মেজাজা নেই, পড়ারও না। দমকা হাওয়ায় কাগজটা উড়ে গেল, ধরতেও ছুটল না কেউ।
এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না বছর সত্তরের স্বপন সরকার। বলছেন, ‘সাগরের মৃত্যু সহ্য করতে পারল না বলে সৌমিত্র নিজের জীবনটাই শেষ করে দিল! ভাবতেই তো পারছি না!’’
টানা কেঁদে-কেঁদে যেন কাঁদার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন সৌমিত্র মা রূপালি। নিচু গলায় বলে যান, ‘‘ও তো বড্ড ভালবাসত আমাদের। আট বছরের বোন সৌরবী ছিল চোখের মণি। সব এত সহজে ছেড়ে গেল?’’
বলতে-বলতেই মুখ তোলেন রূপালি, ‘‘শেষ সময়টায় কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিল ও, জানেন! বলছিল, আমি ঠিক বাড়ি যাব...’’
কান্নায় ভেঙে পড়েন মা। কথা শেষ হয় না।