Advertisement
E-Paper

স্কুল থেকেও গাছতলায় রাবেয়ারা

বাড়ির দাওয়ায় বসে এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে বছর সাতেকের শাহানুর। দিদি ফেরদৌসি বিবি অনেক বলেও ভাইকে স্কুলমুখো করাতে পারছেন না। শেষে গালে পিঠে কয়েকটা চড় বসাতে কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে গেল সে। কিন্তু তারপর নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না দিদি।

সুজাউদ্দিন

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ০২:২১
আমিনাবাদের বাগানে চলছে শিশুশিক্ষাকেন্দ্র। বিশ্বজিৎ রাউতের তোলা ছবি।

আমিনাবাদের বাগানে চলছে শিশুশিক্ষাকেন্দ্র। বিশ্বজিৎ রাউতের তোলা ছবি।

বাড়ির দাওয়ায় বসে এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে বছর সাতেকের শাহানুর। দিদি ফেরদৌসি বিবি অনেক বলেও ভাইকে স্কুলমুখো করাতে পারছেন না। শেষে গালে পিঠে কয়েকটা চড় বসাতে কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে গেল সে। কিন্তু তারপর নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না দিদি। ভার মুখে বাড়ির লাগোয়া আম বাগানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘কী করি বলুন, বাড়ি থেকে ১০০ মিটার দূরের স্কুলটা চলে গিয়েছে এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। মিড-ডে মিলও বন্ধ। চড়া রোদে এতটা পথ যেতে আসতে বড়দের কী কষ্টই না হয়। তাহলে বাচ্চারা পারবে কী করে ?’’

মাস তিনেক আগে জমিদাতারা শিশুশি‌ক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। সেই থেকে বন্ধ ডোমকলের আমিনাবাদ বটতলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। বন্ধ মিড-ডে মিলও। বাধ্য হয়ে এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরে গাছ তলায় বসেছে স্কুল। বিষয়টি নিয়ে পঞ্চায়েত ও প্রশাসনিক স্তরে কয়েক দফা আলোচনা হলেও ফল মেলেনি। জমিদাতাদের দাবি, চাকরি দেওয়ার কথা বলে জমি নিলেও চাকরি মেলেনি। এমনকী মিড-ডে মিল রান্নার রাঁধুনির কাজও দেওয়া হবে বলে দেওয়া হয়নি। অন্য দিকে, স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, গ্রামের মোড়লেরা নিজেদের এলাকায় স্কুল গড়তে যেমন খুশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে তাদের।

বছর চারেক আগে গ্রামের লুৎফর শেখের ১০ শতক জমিতে গড়ে ওঠে ওই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। গ্রামের ইট বিছানো রাস্তা থেকে ৫০ মিটার দূরে তৈরি হয় তিনটি পাকা ঘর, রান্নাঘর ও শৌচাগার। মূল রাস্তা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য হাত কয়েকের সরু রাস্তায় স্থানীয় পঞ্চায়েত ইট বিছিয়েও দিয়েছে বছর খানেক আগে। এতদিন সব ঠিকঠাক চললেও চলতি বছরের গত ১১ ফেব্রুয়ারি স্কুলে চাকরি ও রাঁধুনির কাজে নিয়োগের দাবিতে রাস্তা লাগোয়া জমির মালিক পরিমন বিবি ও স্কুলের জমিদাতা পরিবার সেই রাস্তা ঘিরে দেন। বাধ্য হয়ে মাঠের আলপথ ধরে পড়ুয়া- শিক্ষকরা স্কুলে যাতায়াত করছিলেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। দিন তিনেক পরে স্কুলের চারপাশ বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। বন্ধ স্কুলে এখন গজিয়েছে লম্বা ঘাস। গ্রামবাসীদের দাবি, কার্যত শেয়ালের ঠেকে পরিণত হয়েছে ওই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, ‘‘কিছু মানুষের একগুয়েমির কারণে কচিকাঁচাদের গনগনে রোদে এক কিলোমিটারেরও বেশি পথ হেঁটে পড়তে যেতে হচ্ছে। গাছ তলায় বসে পড়তে হচ্ছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘একটা সময় জমি এবং রাস্তা দেওয়ার পরে এখন চাকরির দাবি তুলে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রশাসনকে বিষয়টি একাধিক বার জানিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’’ তিন জন শিক্ষক, এক জন শিক্ষিকা ১৭০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ওই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র এখন স্যাঁতসেতে বাগানে নোংরার মধ্যে চট বিছিয়ে চলছে ক্লাস করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও কেন্দ্রের প্রথম সহায়ক মহম্মদ আব্দুর রসিদ খান বলেন, ‘‘২০১১ সাল থেকে আমরা লুৎফর শেখের জমিতেই স্কুল চালাচ্ছি। কোনও অসুবিধা হয়নি। হঠাৎ মাস তিনেক আগে দেখি স্কুলে যাওয়ার সরু রাস্তাটা বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে।’’ তিনি জানান, বাধ্য হয়ে মাঠের আলপথ ধরে স্কুলে যাতায়াত শুরু হয়। কিন্তু তাতেও রেহাই মেলেনি। দিন কয়েকের মধ্যে গোটা স্কুল ঘিরে বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘‘বাধ্য হয়ে নিজেরই বাড়ির পিছনে বাগানে স্কুল শুরু করেছি।’’ চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রাবেয়ার কথায়, ‘‘রোদে এতটা রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে আসতে ভাল লাগে না। কিন্তু এই স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে পড়ছি। তাছাড়া এখন আর কোথাও ভর্তিও নেবে না।’’ একই সুর ফাতেহা বেগম, সোনালী খাতুনদের গলায়। তাদের আশঙ্কা, এ ভাবে চলতে থাকলে বর্ষায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে।

আর কী বলছেন জমিদাতারা?

লুৎফর শেখের স্ত্রী খোদেজা বিবি বলেন, ‘‘স্কুল করতে জমি দিলে চাকরি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় চার বছর হয়ে গেলেও কেউ কথা রাখেনি। আত্মীয় পরিমনকে রাঁধুনির কাজেও নিয়োগ করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাই স্কুলে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’’

ডোমকলের বিডিও রবীন্দ্রনাথ মিশ্র বলেন, ‘‘ওই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র নিয়ে আমরাও বিব্রত। বিষয়টি নিয়ে ব্লক প্রশাসনের তরফে কয়েকবার আলচনায় বসা হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘স্থানীয় মানুষ নিজেদের সন্তানের কথা ভেবে এগিয়ে না এলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।’’

Suja Uddin Domkal School student teacher school building
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy