Advertisement
E-Paper

দুধ কলা খেয়ে মা-ছেলেকে কোপাল হারু

ভুলে যাওয়া সময়ের ডায়েরিতে হলদে পাতা ওড়ে, তাতে শুকনো রক্তের দাগ। এক সময়ে হইচই ফেলে দেওয়া খুন-জখমের ইতিবৃত্ত চুপ করে থাকে পুলিশ ফাইলে। নিশ্চুপে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এক দিন সংবাদের কেন্দ্রে চলে আসা আত্মীয়-পরিজন। কিনারা হয়েছে কি সব রহস্যের? ভুলে কি গিয়েছে সবাই? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।লোকটা যে মোটে দশ মাস আগে জেল থেকে বেরিয়েছে, বোধহয় মনেই ছিল না কারও। জেল যে তাকে আরও বেপরোয়া করে দিয়েছে, তা-ও হয়তো খেয়াল ছিল না। দিনটা ছিল শনিবার। নবদ্বীপ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে বাবলারি পঞ্চায়েতের রামচন্দ্রপুরে দিনটা শুরু হয়েছিল ছাপোষা ভাবেই।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৫৫
এই বাড়িতে জীবনবাবুকে কুপিয়ে ছিল হারু। তা মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠেন শিখা (ছবিতে)—নিজস্ব চিত্র।

এই বাড়িতে জীবনবাবুকে কুপিয়ে ছিল হারু। তা মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠেন শিখা (ছবিতে)—নিজস্ব চিত্র।

লোকটা যে মোটে দশ মাস আগে জেল থেকে বেরিয়েছে, বোধহয় মনেই ছিল না কারও।

জেল যে তাকে আরও বেপরোয়া করে দিয়েছে, তা-ও হয়তো খেয়াল ছিল না।

দিনটা ছিল শনিবার। নবদ্বীপ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে বাবলারি পঞ্চায়েতের রামচন্দ্রপুরে দিনটা শুরু হয়েছিল ছাপোষা ভাবেই।

গ্রামে ঢোকার মুখেই ঘোষপাড়া। সকাল-সকাল পাশের বাড়িতে গল্প করতে গিয়েছিল হারু ঘোষ। পড়শি বুদ্ধদেব প্রামাণিক তার বন্ধুও বটে। দুধ-কলা দিয়ে তাকে মুড়ি দিয়েছিলেন পড়শির বৌ অনিমা।

খানিক বাদে হঠাৎ হইচই শুনে পড়শিরা ছুটে এসে দেখেন, অনিমার দশ বছরের ছেলে শুভঙ্কর ওরফে কেবলের গলা টিপে ধরেছে হারু। ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেটাকে তার কবল থেকে ছাড়িয়ে নেন কয়েক জন। বাইরে কলতলায় নিয়ে গিয়ে তার মাথায় জল ঢালতে শুরু করেন। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। ছেলের মাথা কোলে করে সেখানেই বসে পড়েন অনিমা।

হারুর দিকে তখন কারও চোখ নেই।

উঠোনে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মাঠ ফেরত শ্যামল ঘোষ। হাতে ধারালো দা। আচমকা সেই দা ছিনিয়ে নিয়ে অনিমা আর কেবলকে এলোপাথাড়ি কোপাতে শুরু করে হারু। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে ওঠে। গুঙিয়ে ওঠে কেবল, অনিমা রক্তে মাখামাখি হয়ে লুটিয়ে পড়েন।

এতটাই আচমকা, যে কয়েক মুহূর্ত কেউ নড়তে পারেনি।

আর সেই ফাঁকে রক্তমাখা দা হাতে বাবলারির রাস্তা দিয়ে ছুটতে শুরু করে হারু। গোটা বাবলারি তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।

কাছেই সুভাষনগরে নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিলেন সত্তর ছুঁই-ছুঁই জীবন চক্রবর্তী। বাবলারি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান। এটা তাঁর রোজকার অভ্যেস। হঠাৎই বারান্দায় লাফিয়ে ওঠে হারু। বৃদ্ধ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর গলা, ঘাড়, পিঠ লক্ষ করে দায়ের কোপ নামিয়ে আনতে থাকে পেশল মিশকালো একটা হাত। দুর্বল দু’টো হাত তুলে মাথাটা আড়াল করার চেষ্টা করেন বৃদ্ধ। ডান হাতের তর্জনী সমেত তালুর কিছুটা উড়ে ছিটকে পড়ে উঠোনে। রক্তে ভেসে যেতে থাকে শরীর।

সিঁড়ি দিয়ে তখন ছুপিয়ে নামছে বৃষ্টির জল। টাটকা রক্ত মিশে তার রঙও টকটকে লাল। জীবনবাবু লুটিয়ে পড়েন। শিখা দাঁড়িয়ে ছিলেন কাছেই। কিন্তু নড়তে পর্যন্ত পারেননি, কয়েক লহমায় ঘটে যায় সব। চোখ অন্ধকার হয়ে আসে... রক্তস্রোতের পাশেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান শিখা।

হারু বেরিয়ে চলে যায় পাশে বাহাদুর ঘোষের বাড়িতে। কিন্তু সে বাড়িতে তখন পাঁচ ভাই হাজির। তাঁরা হারুকে ধরে ফেলেন।

এগারো বছর আগের ঘটনা, ২০০৫ সালের ৭মে।

কলতলাতেই মারা গিয়েছিলেন অনিমা, কয়েক ঘণ্টা পরে নবদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে কেবল মারা যায়। কিন্তু জীবনবাবু বেঁচে যান। কয়েক দিন যমে মানুষে টানাটানির পরে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন। কিন্তু শরীরের ডান দিকটা অকেজো হয়ে যায়। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় তাঁর ব্যবসাপাতি, রোজগার। এখনও চমকে-চমকে ওঠেন, বেশি লোক দেখলে ভয় পান।

জোড়া খুনের অস্ত্র-সহ ধৃত হারুর বিচার হয়েছিল নবদ্বীপের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। সাক্ষী ছিলেন বিয়াল্লিশ জন। হারুর আইনজীবী ষষ্ঠীভূষণ পাল বারবার তাকে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ প্রতিপণ্য করার চেষ্টা করেন। কি‌ন্তু তাতে লাভ হয়নি। ঠিক এক বছর বাদে, ২০০৬ সালের ১৭ মে হারুকে ফাঁসির সাজা শোনান বিচারক। হারু কলকাতা হাইকোর্ট আপিল করে। তারাও ফাঁসির সাজা বহাল রাখে। তবে শেষমেশ হারুর ফাঁসি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট তা রদ করে যাব্বজীবন কারাদণ্ড দেয়।

কিন্তু... কেন সে দিন এমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল হারু?

আদালতে সাক্ষীদের বয়ানে উঠে আসা তথ্য বলছে, গোটা তল্লাট আগাগোড়াই হারুকে রগচটা বলে জানত। তার কাজ-কারবারও ছিল গোলমেলে। চোলাই মদের কারবার থেকে শুরু করে নানা ধরনের অসামাজিক কাজকর্মে জড়িত ছিল সে। কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুললেই হুমকি দেওয়া, হেনস্থা করা, এমনকী মারধরও বাদ যেত না।

জোড়া খুনের বছর পাঁচেক আগেই, ২০০০ সালের ৩ জুলাই নবদ্বীপের প্রতাপনগরে আটাকলের মালিক ভগীরথ ঘোষকে কুপিয়ে মারা হয়েছিল। ওই ঘটনায় হারু ও তার কয়েক জন সাঙ্গোপাঙ্গকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় কৃষ্ণনগর আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে হারু। ২০০৪ সালের ২৮ জুলাই জামিনে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে ফিরেও আসে।

পুলিশের মতে, জেলে গিয়ে শোধরানোর বদলে বরং ভয়ডর আরও কমে গিয়েছিল হারুর। আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল সে। মনে-মনে কয়েক জনের প্রতি রাগও পুষে রেখেছিল। তাদের অন্যতম পাশের বাড়ির প্রামাণিক পরিবার। বুদ্ধদেব বন্ধু লোক হলেও হারুর অপকর্ম তিনি কোনও দিনই মুখ বুজে মেনে নেন‌নি। বরং বরাবর তার মুখের উপরে অপছন্দের কথা জানিয়ে এসেছেন।

সে দিন, সেই শনিবার, দুই বন্ধুতে তর্ক বেধেছিল। এবং তর্কাতর্কি হতে-হতেই হারুর ভিতরে পোষা রাগ উসকে ওঠে। দেখতে দেখতে খুন চড়ে যায় তার মাথায়। মা-ছেলেকে কোপানোর পরেই তার মনে পড়ে যায়, পঞ্চায়েতের উপপ্রধান থাকার সময়ে জীবনবাবু তাকে বারবার ডেকে ধমকেছেন, ব্যবস্থাও নিয়েছে‌ন তার বিরুদ্ধে। উঠতি নেতা বাহাদুর আবার চোলাই বন্ধ করতে দল পাকাচ্ছে! এদের তো মারতেই হবে! দা হাতে ছুটতে শুরু করে হারু...

এর পরে আরও দশটা বছর কেটে গিয়েছে। বাবলারির পাট চুকিয়ে পাকাপাকি কলকাতায় চলে গিয়েছেন বুদ্ধদেব প্রামাণিক। ব্লাড সুগার আর ‌নানা উপসর্গে কাহিল হারু এখন বর্ধমান জেল হাসপাতালে শয্যাশায়ী। ঘোষপাড়ার এক কোণে ভাঙা কুঁড়েতে মাথা নিচু করে বেঁচে আছেন তার স্ত্রী মমতা। অনেকটাই একঘরে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁত বুনে দুই নাবালিকা মেয়েকে বড় করেছেন মমতা, বিয়ে দিয়েছেন। তাঁত বুনে-বুনে এখন মারাত্মক স্পন্ডিলাইটিসে কাবু, আর বুনতে পারেন না। নিজের বসতভিটে বেচে সেই টাকাটুকু সম্বল করে মেয়ের সঙ্গে এসে থাকছেন তাঁর মা। স্বামীকে দেখতে যান না?

মুখ নামিয়ে ধীরে-ধীরে মাথা নাড়েন মমতা— ‘‘পেরে উঠি না।’’

চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে থাকেন খানিক। তার পর হঠাৎই ফুঁপিয়ে ওঠেন— ‘‘বিয়ের পর থেকে শুধু কষ্টই পেয়ে গেলাম। কেন বলুন তো? আমার কী দোষ?’’

murder nawadip
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy