Advertisement
E-Paper

ছুটন্ত বুলেটের আওয়াজে মনকেমন করে বিপুলের

জাতে সে চুরির সোদর ভাই। লোক ঠকানো বুদ্ধি, হাতের গুণ আর ওস্তাদের আশীর্বাদ— তিনের মিশেল হলে যখন তখন মাহেন্দ্রক্ষণ! কেপমারিকে প্রায় আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে, এমনই কয়েক জন দিকপালের খোঁজ নিল আনন্দবাজার।রাস্তা দিয়ে কালো রঙের কোনও বুলেট যেতে দেখলে আজও বুকের ভিতরে চিনচিনে অনুভূতিটা টের পান বিপুল বিশ্বাস। ঠিক সেই দিনের মতো। তার পর কত বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই বিলাপটা তাঁকে ছেড়ে গেল না!

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:০৬
অঙ্কন: অর্ঘ্য মান্না

অঙ্কন: অর্ঘ্য মান্না

রাস্তা দিয়ে কালো রঙের কোনও বুলেট যেতে দেখলে আজও বুকের ভিতরে চিনচিনে অনুভূতিটা টের পান বিপুল বিশ্বাস। ঠিক সেই দিনের মতো। তার পর কত বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই বিলাপটা তাঁকে ছেড়ে গেল না!

তিনি অনেক বার ভেবেছেন, ব্যাপারটা ভুলে যাবেন। কিন্তু যত বার বাইকের ওই গম্ভীর আওয়াজটা তাঁর কানে যায়, ভুলে যাওয়া তো দূরের কথা, গোটা ঘটনাটাই চোখের সামনে ভাসতে থাকে। ঠিক যেন ছায়াছবি।

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে রানাঘাট ছাড়িয়ে ফুলিয়ার দিকে কিছুটা এগোলেই মাঝবয়সি বিপুলের মোটরবাইকের গ্যারেজ। বুলেটের ভাল মিস্ত্রি হিসেবে এলাকায় তো বটেই, বাইরেও তাঁর যথেষ্ট নামডাক আছে।

লোকে বলে, বুলেটের আওয়াজ শুনেই রোগ ধরতে পারেন বিপুল। কথাটা মিথ্যে নয়। আর সেই কারণেই বাইক সারাতে তাঁর গ্যারাজে ভিড়ও হয় ভালই। পাশাপাশি পুরনো বুলেটও তিনি বিক্রি করতেন। কিন্তু সেটাই যে এমন কাল হবে কে জানত!

এমনই এক বসন্তের বিকেলে একটি অটো এসে দাঁড়াল তাঁর গ্যারাজের সামনে। অটোতে চালক ও সাকুল্যে একজন যাত্রী। চালক চুপচাপ বসে থাকলেন নিজের আসনে। বেরিয়ে এল সেই যাত্রী। সে পুরনো একটি বুলেট কিনতে এসেছে। বাপরে, কী দাপট তার!

বুলেটের নাড়ি-নক্ষত্র যেন সবই তার জানা। বিপুলও এমন বিশেষজ্ঞ-ক্রেতা পেয়ে খুশিতে ডগমগ। গ্যারাজে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি বুলেটের একটির পিঠে থাবা দিয়ে সেই আগন্তুক বলল, ‘‘বুঝলে হে, সবাই একে বুলেট বটে ঠিকই। আসলে তো এ বাঘের বাচ্চা!’’

বিপুলও হাসিমুখে সায় দেন, ‘‘ঠিক, ঠিক। তা বাবুমশাইয়ের নিবাস কোথায়?’’ নিজেকে জাগুলির বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়ে লোকটি অটো চালককে এ বার হুকুম করে, ‘‘ওরে হাঁ করে বসে আছিস কেন? শুভ কাজে এলাম। একটু চা-মুখ করাবি না?’’

বিপুল বাধা দেন, ‘‘আরে না, না। আমি চা আনাচ্ছি।’’ আগন্তুক তাঁকে থামিয়ে দেয়, ‘‘উঁহু, সেটি হবে না। গাড়ি কিনব আমি। চা-ও আমিই খাওয়াব।’’ তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে অটো চালককে পাঠিয়ে দেয় চা আনতে।

এই ফাঁকে ফের কথা শুরু করে লোকটি, ‘‘এই যে অটোচালক ছোকরাকে দেখছেন, ওর নাম চাঁদু। বড় ভাল ছেলে। যখনই প্রয়োজন তখনই চাঁদু হাজির। ফলে সব জায়গাতে ওকেই নিয়ে যায়, বুঝলেন।’’ চা-পর্ব শেষ। এ বার বুলেট একটু চালিয়ে দেখার পালা। পুরনো বাইক বলে কি আর ‘টেস্ট ড্রাইভ’ হবে না!

বিপুলের গ্যারাজের সামনেই বুলেট নিয়ে বার কয়েক চরকি কাটল লোকটা। কপালে ভাঁজ ফেলে লোকটি বলল, ‘‘আওয়াজটা কেমন বেসুরো ঠেকছে হে! মনে হচ্ছে, পিস্টনে একটু গণ্ডগোল আছে।’’ কথাটা আঁতে লাগে বিপুলের। লাগারই কথা। এ তল্লাটে বুলেটের শেষ কথা তিনিই বলেন। নিজে হাতে বাইকের সমস্ত খুঁটিনাটি তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন।

একটু চ্যালেঞ্জের সুরেই বিপুল বলেন, ‘‘এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। আপনি আর এক বার চালিয়ে দেখুন তো!’’ ‘বেশ, তবে তাই হোক’ বলে লোকটি বাইক নিয়ে উঠে পড়ল পিচ রাস্তায়। বেশ দূর থেকেও বিপুল শুনতে পেলেন বুলেটের সেই নিখুঁত আওয়াজ—ডিগ...ডিগ...ডিগ...ডিগ...।

তারপর সে আওয়াজও এক সময় মিলিয়ে গেল। টিক, টিক করে এগিয়ে যায় ঘড়ির কাঁটা। লোকটি আর ফেরে না। এ বার একটু অধৈর্য গলায় বিপুল অটো চালককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘এই যে চাঁদু, দাদা কোথায়? একটু ফোন করো দেখো। কোনও বিপদ হল না তো?’’

অটো চালকের গলায় এ বার স্পষ্ট ঝাঁঝ, ‘‘চাঁদু কাকে বলছেন মশাই? আমার নাম চাঁদু নয়!’’ মাথাটা এক বার বোঁ করে ওঠে বিপুলের। সামলে নিয়ে বলেন, ‘‘সে কী? লোকটিই তো বলল, তোমার নাম চাঁদু। ওর যখনই প্রয়োজন তখনই নাকি তুমি হাজির হয়ে যাও! সব জায়গায় তোমাকেই নাকি সঙ্গে নিয়ে যায়।’’

এ বারে চমকে ওঠে সেই অটো চালকও, ‘‘কী বলছেন দাদা? এ সব মিথ্যে কথা। লোকটিকে আমি চিনিই না। এর আগে কোনও দিন দেখিওনি। একটু আগে রানাঘাট স্টেশনে নেমে পাঁচশো টাকায় অটো ভাড়া করে আমাকে এখানে নিয়ে এল। সেই ভাড়ার টাকাটা নেব বলেই তো আমি দাঁড়িয়ে আছি।’’

বিপুলের শরীর কাঁপতে শুরু করে। এই বুঝি তিনি পড়ে যাবেন। একটু ধাতস্থ হতে গ্যারাজ বন্ধ করে নিজের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে সারা শহর চষে বেড়ালেন তিনি। কিন্তু কোথায় সেই লোক? থানাতেও একটা ডায়েরি করেছিলেন। কিন্তু ডায়েরি কি আর কপালের লিখন বদলে দিতে পারে!

সামনেই ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। দিনরাত কত গাড়ি ছুটে চলেছে। সে দিকে ঘুরেও তাকান না বিপুল। শুধু দূর থেকে ওই ডিগ...ডিগ...ডিগ...ডিগ... আওয়াজটা কানে এলেই তিনি দৌড়ে গ্যারাজের বাইরে চলে আসেন। সেই চিনচিনে ব্যথাটা ফের চাগাড় দিয়ে ওঠে।

Pickpocketers Bike thieves
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy