দিনটা ছিল ১৯৮৬ সালের ১৩ জানুয়ারি, মঙ্গলবার। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন। কনকনে ঠাণ্ডায় অনেক রাত করে দোকান থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন কালিপদ দে। নবদ্বীপ বড়বাজারে লটারির পাইকারি দোকানের হিসেব নিকেশ মিটিয়ে, কাজ গুছিয়ে ফিরতে রোজই সাড়ে বারোটা-একটা বাজতো। দোকান থেকে কালিপদবাবুর বাড়ির দুরত্ব অবশ্য খুব বেশি হলে হাত পঞ্চাশেক। গোস্বামী বাজারের লাগোয়া পবিত্রময় সেনগুপ্ত রোডের বাড়িতে ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়েছেন। ঘুমে চোখটা লেগে এসেছে। এমন সময় বাইরে হইচই। প্রথমে একটু বিরক্তই হয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, এত রাতেও বাজারে কারা যে হল্লা করে, কে জানে। কিন্তু একটু পরেই বাইরে প্রবল চিৎকার, “আগুন, গোঁসাই বাজারে আগুন।”
পড়িমরি করে ছাদে উঠে কালিপদবাবু দেখেছিলেন গোস্বামী বাজারের ঠিক যে অংশে তাঁর দোকান, দাউদাউ করে জ্বলছে সেই জায়গাটা। ওই দৃশ্য দেখে কী ভাবে বাড়ি থেকে বাজার অবধি গিয়েছিলেন, সে কথা আজ আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, রাত পৌনে তিনটে নাগাদ আগুন লেগেছিল। সম্ভবত সর্টসার্কিট। প্রথমে একটি গুড়ের দোকানে আগুন লাগে। সেখানে মজুত ছিল প্রচুর ডালডা। উত্তরে হাওয়ার দাপটে আগুন হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে বাজারের দক্ষিন দিকের কাপড়পট্টি বরাবর। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যায় কমবেশি দু’শোটি দোকান। তবে কোন জীবনহানি হয়নি, এটাই যা বাঁচোয়া।
তখন নবদ্বীপে দমকল কেন্দ্র ছিল না। ফলে কৃষ্ণনগর থেকে ভোর পাঁচটা নাগাদ যখন দমকলের প্রথম ইঞ্জিনটি ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয়, ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে।
তারপর কেটেছে তিরিশটা বছর। নবদ্বীপ শহরের প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র ওই বড়বাজার-পোড়ামাতলা অঞ্চল এখনও তেমনই বিপ্পজনক জতুগৃহ হয়েই আছে। উল্টে এই তিন দশকে জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সর্বত্র বেড়েছে স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানের সংখ্যা। ক্রেতা-বিক্রেতার বাড়বাড়ন্তে নজর এড়িয়ে যাচ্ছে আগুনের বিপদ। এর মধ্যে নবদ্বীপ জুড়ে ঘটেছে ছোটবড় অজস্র অগ্নিকান্ডের ঘটনা। কিন্তু নবদ্বীপ তা থেকে কোন শিক্ষা নেয়নি।
নবদ্বীপ শহরের প্রধান বানিজ্য কেন্দ্রটি পোড়ামাতলা, রাজার বাজার এবং গোস্বামী বাজারকে নিয়ে গড়ে উঠছে। প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার জুড়ে নবদ্বীপের এই বাজার চত্বরের উপর নির্ভর করেন কালনা থেকে কাটোয়া পর্যন্ত বিরাট এলাকার মানুষ। মুদিখানা থেকে প্রসাধনী, কাপড় থেকে বাসনপত্র, মিষ্টি থেকে অলংকার যাবতীয় দ্রব্যের পাইকারি এবং খুচরো কেনাবেচা হয় ওই চত্বরে। কয়েক হাজার ছোট-বড় দোকান। গোডাউন, ছোটখাটো কারখানা। লাখো মানুষের রুটিরুজি। বলা হয় নবদ্বীপের শতকরা সত্তর ভাগ ব্যবসায়ি এই চত্বরেই ব্যবসা করেন। কিন্তু হলে হবে কী? প্রাচীন শহর নবদ্বীপের সবচেয়ে ঘিঞ্জি অঞ্চল হল ওই পোড়ামাতলা-বড়বাজার চত্বর। পায়ে হেঁটে চলা ছাড়া কোনও উপায় নেই। পাশাপাশি রাজার বাজার এবং গোস্বামী বাজার মিলিয়ে বড়বাজারের মুদিখানা, চাল, মুড়ি-বাতাস, গুড়, মাছ,সবজি, কাপড়, সোনা-রূপা, দুধ, মাছ, জুতো, মশলা, ফল সব কিছুরই আলাদা আলাদা ‘পট্টি’ রয়েছে। প্রায় দুই বর্গ কিমি জুড়ে থেকে বড়বাজারের বেশির ভাগ এলাকাই খুব সংকীর্ণ। সাইকেল নিয়ে যেতেও কষ্ট হয়। অন্য কোন গাড়ির প্রশ্নই নেই। সে ক্ষেত্র যদি কখনও আগুন লাগে দমকলের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া বিশেষ কিছুই করার থাকবে না।
নবদ্বীপ দমকল কেন্দ্রের ওসি শক্তিরঞ্জন দে মনে করেন আগুনের বিপদ থেকে বাঁচার জন্য নবদ্বীপের সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতা মানসিকতা। কেন না আগুন নিয়ে সামান্যতম সচেতনতা নেই। অগ্নিসুরক্ষা বিধির মানতে চান না কেউই। বেশির ভাগ দোকানে আগুন ঠেকানোর সামান্য উপকরণটুকুও নেই। তাঁর কথায়, “জতুগৃহের মধ্যে বসে আগুন নিয়ে খেলা করছেন এই শহরের মানুষ।”
নবদ্বীপ বড়বাজারের অন্তর্গত দু’টি বাজারই ব্যক্তি মালিকানাধীন। তার মধ্যে রাজার বাজার পরিচালনা করেন নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতি। অন্যটি অর্থাৎ গোস্বামী বাজার নবদ্বীপের সোনার গৌরাঙ্গ মন্দিরের গোস্বামীদের। দ্বিতীয় বাজারটি আয়তনে অনেক বড়। মন্দিরের বর্তমান প্রধান স্বরূপ দামোদর গোস্বামী আগুনের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলেন, “বাজারের মধ্যে কয়েকটি টিউবওয়েল এবং একটি কুয়ো আছে। তা ছাড়া পাশেই গঙ্গা। সব মিলিয়ে আগুন ঠেকানোর ব্যবস্থা তো রয়েছে।” কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয় সেটা তিনিও জানেন। তা হলে? উত্তরে প্রবীণ গোস্বামী বলেন, ‘‘দীর্ঘদিনের প্রাচীন বিশাল এই বাজার সংস্কার করার মতো অর্থ এবং লোকবল কোনটিই আমার নেই। এখনও বাজারে দৈনিক মাত্র একটাকা খাজনা দিয়ে লোকে ব্যবসা করছেন।”
কিন্তু নবদ্বীপ পুরসভা যদি কিছু করতে চায় অনুমতি দেবেন? জবাবে স্বরূপ দামোদর গোস্বামী বলেন, “না দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই বাজার দেবোত্তর সম্পত্তি। হস্তান্তর করার শর্ত ছাড়া পুরসভা বাজারের সংস্কার করতে চাইলে আপত্তি কেন থাকবে?”
কিন্তু একটি মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তির সংস্কার সাধনে পুরসভাই বা রাজি হবে কেন? ফলে জতুগৃহের আশু বিপদ মুক্তির সম্ভবনা আছে বলে মনে হয় না।