Advertisement
E-Paper

বিয়ের পরেই পাচার হচ্ছে কনে

রাজ্যে নারী পাচারে অন্যতম এগিয়ে থাকা জেলা মুর্শিদাবাদ। প্রশাসন মানুক বা না মানুক, এই নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সমীক্ষা বলছে, জেলার ২৬টি ব্লকে ছড়িয়ে থাকা ১৫-১৯ বছরের মেয়েরা অনেকে কর্মসূত্রে ভিন্ রাজ্যে চলে যাচ্ছে। আর ফিরছে না।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:০৪

রাজ্যে নারী পাচারে অন্যতম এগিয়ে থাকা জেলা মুর্শিদাবাদ।

প্রশাসন মানুক বা না মানুক, এই নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সমীক্ষা বলছে, জেলার ২৬টি ব্লকে ছড়িয়ে থাকা ১৫-১৯ বছরের মেয়েরা অনেকে কর্মসূত্রে ভিন্ রাজ্যে চলে যাচ্ছে। আর ফিরছে না।

প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০১৪ সালে জেলায় ২২টি নাবালিকা অপহরণের মামলা হয়েছে। ২০১৫ সালে সংখ্যাটা এক লাফে ৪২৯ এবং গত বছর অক্টোবর পর্যন্ত ৪৪২-এ পৌঁছেছে। এদের অধিকাংশই মেয়ে। সাধারণ ভাবে এদের অর্ধেকের বেশি ভাগ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বাকিদের আর হদিস মেলে না। একটা অংশ পাচার হয়ে যায় ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ বা কাশ্মীরে। পরিবার পরে তাদের খোঁজ পেলেও আর ঘরে ফেরাতে পারে না।

জেলা পুলিশের মতে, নারী পাচার হয় কয়েকটি পন্থায়। যেমন হঠাৎ করে নতুন কেউ এলাকায় এসে সকলের সঙ্গে ভাব জমায়। স্থানীয় ক্লাবকে টিভি কিনে দেয়। পরে স্থানীয় কোনও মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়ের বাবা বিত্তবান জামাই দেখে বিয়ে দেন। বউ নিয়ে দিল্লি যায় লোকটি। এবং দিন কয়েকের মধ্যে তাকে কিছু ‘বন্ধু’র জিম্মায় রেখে সটকে পড়ে। মেয়েটি হাতবদল হতে থাকে।

এক বেসরকারি সংস্থার জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী জানান, সাগরদিঘি থানার কড়েয়া এলাকার ১৪ বছরের স্কুলছাত্রীর বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন তার সৎমা। তাঁরা খবর পেয়ে গিয়ে হাজির হলে মেয়েটিকে পাড়ার এক বাড়িতে রেখে ভোরে বিয়ে দিয়ে দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে নানা ভাবে সে হাতবদল হচ্ছিল। মেয়েটি বাড়িতে জানায়, দিল্লিতে পাড়ার এক কাকুকে সে চিনতে পেরেছে। সেই কাকু যে তাকে পাচারের ফন্দি এঁটেছে তা সে বুঝতে পারেনি। পরে পুলিশ গিয়ে লোকটিকে পাকড়াও করে।

বিয়ে দেওয়ার নাম করে কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বেলডাঙার ভাবতা এলাকার মেয়ে শর্মিলাকে (নাম পরিবর্তিত)। কিন্তু তিন বছরেও সে এক বার বাড়ি না আসায় উদ্বিগ্ন বাবা-মা পুলিশকে জানান। পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু পাচার চক্রের চাপে মেয়েকে তাদের কাছেই ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন বাবা-মা।

বছর দুই আগে কাজ দেওয়ার নাম করে লালগোলার একটি মেয়েকে উত্তরবঙ্গের দিনহাটায় নিয়ে যান তার জামাইবাবু। সেখানে তাকে বিক্রির চেষ্টা হয়। বেলডাঙার বেগুনবাড়িতে তার দিদির বাড়ি। সেখান থেকে খবর পেয়ে দিনহাটায় এক যৌনপল্লির থেকে পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধার করে।

ভগবানগোলার টিকলিচরের এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের একটি ছেলের। বিয়ের নাম করে মহারাষ্ট্রের পুণেতে নিয়ে তাকে চক্রের হাতে বিক্রি করে দেয় ছেলেটি। পুলিশ জানতে পেরে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটির পরিবার তাকে নিতে অস্বীকার করে। পরে পুলিশ নানা ভাবে চেষ্টা করে তাকে ঘরে ফেরায়।

নারী পাচার নিয়ে কাজ করা এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী খাদিজা বানুর মতে, হারিয়ে যাওয়া মেয়েরা বা তার পরিবার বহু সময়ে লোকলজ্জায় থানা পর্যন্ত পৌঁছয় না। ফলে পুলিশ এদের ঘরে ফেরানোর যে পরিসংখ্যান দেয়, তা ঠিক নয়। মুর্শিদাবাদের প্রায় ১৫ লক্ষ নারী-পুরুষ অন্য রাজ্যে নানা কাজ করেন। তাঁদের অধিকাংশ মেয়ে, যাঁদের পরিবার জানে না তাঁরা কোথায় থাকেন। তাদের খোঁজ করাও ছেড়ে দিয়েছে পরিবার। কখনও এর-তার হাত দিয়ে তারা বাড়িতে টাকা পাঠায়। কেউ আবার তা-ও পাঠাতে পারে না। এদের অনেকেই হাতবদল হতে হতে
হারিয়ে যায়।

খাদিজার দাবি, ‘‘এই মেয়েদের কোনও হিসেব পুলিশের কাছে নেই। শিক্ষার প্রসার ও আর্থিক উন্নতি না হলে সামগ্রিক ভাবে কোনও কাজ হবে না।’’ তবে বেসরকারি সংস্থার আর এক কর্মী জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা জেলা ও ব্লক প্রশাসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে
কাজ করছি।’’

পাচার রুখতে কী করা হচ্ছে?

পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, ‘‘মূলত সাইবার ক্রাইম দিয়েই যেহেতু মেয়েদের শিকার করা হয়, আমাদের কর্মীরা স্কুলে-কলেজে গিয়ে ছাত্রীদের সতর্ক করছেন। খবর দেওয়ার জন্য তাদের মোবাইল নম্বর দেওয়া হচ্ছে।’’ অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) শমনজিৎ সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘জেলার ন’টা ব্লক বেছে নিয়ে ২৭০ জন কন্যাশ্রী যোদ্ধাকে কাজে নামানো হয়েছে। তারা স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছে।’’ জেলা শিশু সুরক্ষার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক অর্জুন দত্তের বক্তব্য, ‘‘নাবালিকা হারানোর সব ঘটনায় এখন পুলিশ ‘এফআইআর’ নেয়। পুলিশের কাছে যেতে সমস্যা থাকলে দিন-রাতের যে কোনও সময় ১০৯৮ নম্বরে অভিযোগ জানালেই ব্যবস্থা
নেওয়া হচ্ছে।’’

নারী পাচার কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। বরং তা রকমসকম বদলেছে। আগে যেখানে গ্রামের কোনও প্রবীণ মহিলা পড়শির মেয়েকে বিক্রি করে দিত, এখন কাজের নাম তাকে বিহার নিয়ে যাচ্ছে। ঝুঁকি আছে জেনেও অভাবের তাড়নায় বাবা-মা যদি মেয়েকে ছেড়ে দেন, আটকাবে কে?

Trafficking
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy