Advertisement
E-Paper

আলোর উত্‌সবে ছেলের স্মৃতিই সম্বল দম্পতির

একটা বছর ঘুরে সব আবার আগের মতো। সেই আলোর রোশনাই, হইচই, সেই পুজো। শুধু বাড়িটা অন্ধকার। গত বছর কালী প্রতিমা বিসর্জনের দিন ক্লাবের সঙ্গে শোভাযাত্রায় যাওয়ার কোনও কথাই ছিল না বাপ্পার। বরং গাড়ি নিয়ে বেরনোর কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে ভাড়া বাতিল হয়ে গেল। আজও আক্ষেপ যায়নি বাবা-মার। কী কুক্ষণে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছিল! বিসর্জনের শোভাযাত্রায় যেমনটা হয়, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই, চিত্‌কার, উচ্ছ্বাস সবই। কিন্তু আমিন বাজারের কাছে আসতেই যেন নেমে এল অন্ধকার।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৩৩

একটা বছর ঘুরে সব আবার আগের মতো। সেই আলোর রোশনাই, হইচই, সেই পুজো। শুধু বাড়িটা অন্ধকার।

গত বছর কালী প্রতিমা বিসর্জনের দিন ক্লাবের সঙ্গে শোভাযাত্রায় যাওয়ার কোনও কথাই ছিল না বাপ্পার। বরং গাড়ি নিয়ে বেরনোর কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে ভাড়া বাতিল হয়ে গেল। আজও আক্ষেপ যায়নি বাবা-মার। কী কুক্ষণে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছিল!

বিসর্জনের শোভাযাত্রায় যেমনটা হয়, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই, চিত্‌কার, উচ্ছ্বাস সবই। কিন্তু আমিন বাজারের কাছে আসতেই যেন নেমে এল অন্ধকার। আচমকাই সব শেষ হয়ে গেল। অন্য আরেকটি বারোয়ারির পুজোর সদস্যরা কোনও ‘কারণ’ ছাড়াই বাপ্পাকে খুন করল। শিউরে উঠেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাঁরাই জানিয়েছিলেন, সেবক সঙ্ঘের শোভাযাত্রার কাছাকাছি চলে এসেছিল অন্য প্রতিমা। তাই সামান্য বচসা। তারপরই সেবক সঙ্ঘের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাপ্পাকে টেনে এনে মারধর করেছিল অন্য ক্লাবের ছেলেরা। রাস্তার উপরে ফেলে ইট দিয়ে মাথা থঁতেলে মেরে ফেলা হল ছেলেটাকে।

সেবক সঙ্ঘের ছেলেরা সেদিন প্রতিবাদ করেছিল। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা এসেছিল বারবার। খবরের কাগজে বড় বড় হেডিং হয়েছিল। বাবা হারুগোপাল ঘোষের অভিযোগের ভিত্তিতে একজনকে গ্রেফতারও করা হল। কিন্তু বাকীদের ধরা যায়নি আজও। গ্রেফতার হওয়া অপরাধীও আপাতত জামিনে মুক্ত। পুলিশ বলছে তদন্ত চলছে। হারুগোপালবাবু বলেন, “প্রায়ই থানায় যাই। দেড়-দু’ঘন্টা করে বসে থাকি। কোনও দিন অফিসারের সঙ্গে কথা হয়, কোনও দিন হয় না। ফিরে আসি। ঠিক কবে তদন্ত শেষ হবে বলতে পারেন?” দোষীদের শাস্তি একদিন হলেও হতে পারে। কিন্তু তাতে কার কী এসে যায়!

গত বছরই কালীপুজোর বিসর্জনের পর আবার চকেরপাড়া মেতেছিল জগদ্ধাত্রী পুজোয়। সেই আলো, সেই উত্‌সাহ। একই রকম বিসর্জনের শোভাযাত্রা। এ বছর আবার। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রীরা আসছেন, যাচ্ছেন।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পাশেই চকেরপাড়ায় বাপ্পা ঘোষের বাড়ি। বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে ছিল সংসার। গাড়ি চালিয়েই উঠত সংসার খরচ। বছর ছাব্বিশের ছেলেটা একটু আগে ভাগেই বুঝে নিয়েছিল সংসারের দায়িত্ব। কিন্তু গতবারের কালীপুজোর উল্লাস কেড়ে নিয়েছে তাঁর প্রাণ। তারপর থেকেই হতাশায় ডুবে গিয়েছেন বাপ্পার বৃদ্ধ বাবা হারুগোপাল ঘোষ। অসুস্থ মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

তবে বাপ্পা এখনও দাঁড়িয়ে আছেন টকটকে লাল সূর্যটাকে আঙুলের ডগায় তুলে। ছবিতে। ওইটুকুই সম্বল। সহায়হীন বাবা, মার কাছে ওইটুকুই প্রাণ। একটা বছরে বদলে গিয়েছে সব। বাপ্পার স্ত্রী পারমিতাদেবী সাড়ে তিন ও দেড় বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে চলে গিয়েছেন বাপের বাড়ি। পুত্রহারা বৃদ্ধ দম্পতির কাছে নাতিরাও নেই। এই দুঃখ কোথায়, কার কাছে বলবেন ভেবে পান না মতিদেবী, বাপ্পার মা। কালীপুজোর দিন সকাল থেকেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত উচাটন। “বারবার মনে হচ্ছে বাপ্পা এসেই তাড়া দেবে, রান্নাঘরে পিঁড়িটা পেতে বসে খেতে চাইবে। পুজো মণ্ডপে যেতে হবে”, ডুকরে কেঁদে ওঠেন মতিদেবী।

পুজোর দিনগুলো তো এমনই হত প্রতিবার। এ বছরই ব্যতিক্রম। ভাইফোঁটার ঠিক আগের দিন রাতে দুর্ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল। সে দিন সকালে দিদির সঙ্গে দোকানে ঘুরে ঘুরে জামা কাপড় কিনেছিলেন বাপ্পা। সে সব পোশাক আর কারও পরা হয়নি। শেষ যাত্রায় বাপ্পার পরনে ছিল দিদির দেওয়া জামা প্যান্টটাই। আর দিদি মিতালি ভাইয়ের শেষ স্মৃতি হিসাবে যত্ন করে তুলে রেখেছেন সেই শাড়িটা। এবার আর আসবেন না তিনি। বাবা মা একাই কাটাবেন উত্‌সবের দিনগুলো।

বৃদ্ধ হারুগোপালবাবু অনুভব করেন এক বছরে যেন আরও বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তবু পাত্রবাজারের একটি দোকানে কাজ করতে হয় তাঁকে। তাঁর রোজগারেই খুঁড়িয়ে চলে সংসার। ক্লাবের ছেলেরা প্রথম কয়েকদিন এসেছিল, খোঁজ খবর নিয়েছিল। এখন সে সব অতীত। রাজ্য জুড়ে রাজনীতির ঝড় বয়ে গেলেও, কেউ কোনও দিন আসেননি এই দম্পতিকে দেখতে।

kali puja celebration of lights krishnanagar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy