Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
পাচারের পথে আটক একাধিক ট্রাক

ইউরিয়া সার অমিল, নদিয়ায় ক্ষুব্ধ চাষিরা

সবুজ রঙের বস্তা বোঝাই চার-পাঁচটি ট্রাক খাঁ খাঁ দুপুরে কৃষ্ণনগর-নবদ্বীপ রাজ্য সড়কের গৌরাঙ্গ সেতু পেরিয়ে বর্ধমানের দিকে বাঁক নেয়। তাতেই সন্দেহ হওয়ায় রেল গেটে ট্রাকগুলির পথ আটকান চাষের কাজে যুক্ত স্থানীয় কয়েক জন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন জেলা কৃষি দফতরের কর্তারা। পুলিশের উপস্থিতিতে তল্লাশি করে দেখা যায় প্রতিটি ট্রাকে ঠাসা দশ টন করে সরকারি ভর্তুকি মূল্যের ইউরিয়া সার। বেআইনি ভাবে ওই সার নদিয়া থেকে পাচার হচ্ছিল বর্ধমানে।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:৩৯
Share: Save:

সবুজ রঙের বস্তা বোঝাই চার-পাঁচটি ট্রাক খাঁ খাঁ দুপুরে কৃষ্ণনগর-নবদ্বীপ রাজ্য সড়কের গৌরাঙ্গ সেতু পেরিয়ে বর্ধমানের দিকে বাঁক নেয়। তাতেই সন্দেহ হওয়ায় রেল গেটে ট্রাকগুলির পথ আটকান চাষের কাজে যুক্ত স্থানীয় কয়েক জন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন জেলা কৃষি দফতরের কর্তারা। পুলিশের উপস্থিতিতে তল্লাশি করে দেখা যায় প্রতিটি ট্রাকে ঠাসা দশ টন করে সরকারি ভর্তুকি মূল্যের ইউরিয়া সার। বেআইনি ভাবে ওই সার নদিয়া থেকে পাচার হচ্ছিল বর্ধমানে।

গত রবিবার নবদ্বীপ রেলগেট থেকে ওই চারটি ট্রাক ছাড়াও নদিয়ার আমঘাটা, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর গাছা এবং সিঙ্গারিয়া থেকে আরও তিনটি ট্রাক ভর্তি ইউরিয়া বাজেয়াপ্ত করেছে কৃষি দফতর। একই ভাবে ওই ট্রাকগুলিতেও বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদে পাচার হচ্ছিল ইউরিয়া।

কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদে যত ধরনের সার ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তার মধ্যে কেবল ইউরিয়া সারই সরকার নিয়ন্ত্রিত ভর্তুকি মূল্যে পাওয়া যায়। বিভিন্ন জেলার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সার জেলা কৃষি দফতর অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেন কৃষি দফতরের আধিকারিকেরা। বর্ধমান বা মুর্শিদাবাদের মতো কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে ইউরিয়ার চাহিদা নদিয়ার থেকে অনেক গুণ বেশি। বোরো ধানের চাষে ইউরিয়া ‘চাপান’ সার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় বোরো মরসুমেও ইউরিয়ার চাহিদা থাকে তুঙ্গে। যে কারণে নদিয়া থেকে বেআইনি ভাবে ইউরিয়া পাচার নতুন কোনও ঘটনা নয় বলেই জানান দফতরের কর্তারা।

নদিয়ার সহ কৃষি অধিকর্তা (সার) মনোরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, “বোরো ধানের প্রধান সারই হল ইউরিয়া। সেই ইউরিয়া উৎপাদনে এ বার ঘাটতি থাকায় বাজারে চাহিদা মতো যোগান নেই। এই সুযোগটাই কিছু আসাধু ব্যবসায়ী নিতে চাইছেন। আমরা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি।” অন্য দিকে নদিয়ার উপ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) বিকাশচন্দ্র বিশ্বাস বলেন, “মাস দুয়েক ধরে আমরা পুরো বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রেখেছি। চাষিরা যাতে ন্যায্য দামে প্রয়োজন মতো ইউরিয়া পান সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত অভিযানে যাচ্ছেন আধিকারিকেরা।” জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতি মধ্যে তাদের তরফে পাইকারি এবং খুচরো ব্যবসায়ী মিলিয়ে ২৭০টি বিক্রয় কেন্দ্র ‘ভিজিট’ করা হয়েছে। নানা অসঙ্গতির জন্য ৩ জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, ৪০ জনকে সতর্ক করা হয়েছে এবং ১১০ জনকে শোকজ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ৬টি কেন্দ্রে ‘স্টপ সেলের’ নির্দেশ দেওয়া হয় ও ৪টি কেন্দ্র ‘সিজ’ করা হয়েছে।

কৃষি দফতরের হিসেব অনুযায়ী, নদিয়ায় ৭০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরো ধান চাষ হয়। ও দিকে বর্ধমানের সহ কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, “আমাদের জেলায় প্রায় দু’লক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়। স্বাভাবিক ভাবেই বর্ধমানে ইউরিয়ার চাহিদা এখন আকাশছোঁয়া। এ বার উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় যোগানের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি।”

নদিয়ার হোগলবেড়িয়ায় কৃষক শঙ্কর মণ্ডল, মুকুন্দপুরের নারায়ণ পাল বা বর্ধমানের জামালপুরের ষষ্ঠী পাঁজার অভিজ্ঞতাও এক রকম। তাঁরা জানান, সাধারণ ইউরিয়ার ৫০ কেজির বস্তার সরকার নির্ধারিত বিক্রয় মূল্য ২৮৪ টাকা এবং ‘নিম কোটেড’ ইউরিয়ার ৫০ কেজির বস্তার সরকার নির্ধারিত বিক্রয় মূল্য ২৯৮ টাকা। অথচ বাজারে কিনতে গেলে প্রতি বস্তার জন্য দিতে হচ্ছে ৪৩০-৪৫০ টাকা। দরদাম করতে গেলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘বিক্রি নেই’। ফলে ওই দামেই সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা।

শঙ্করবাবু বলেন, “হিসেব মতো এ বার প্রতি কেজি খুচরো ইউরিয়ার দাম হওয়া উচিত ৬ টাকার আশপাশে। অথচ এখন কমবেশি ৯ টাকা কেজি দরে ওই ইউরিয়া খুচরো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের আশঙ্কা ওই দাম আরও বাড়বে। কিন্তু আমরা নিরুপায়।”

একই অভিজ্ঞতা খুচরো সার বিক্রেতা মদন সরকারের। তিনি বলেন, “রবিবার জেলার বিভিন্ন জায়গায় সার পাচার ধরা পড়ার পরে কেউ আর সার বেচতে চাইছেন না। কিনতে গেলেই বলছেন মাল নেই, বেশি দামে কিনতে হবে। ওই দামে রাজি হলে তবেই ইউরিয়া পাওয়া যাচ্ছে।”

যদিও নদিয়া জেলা অ্যাগ্রো ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জেলায় ওই দামে ইউরিয়া বিক্রির অভিযোগ ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন। ভবানীবাবু বলেন, “অভিযোগ ভিত্তিহীন। ইউরিয়ার মতো সার কোম্পানির কাছ থেকে প্রথমে ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে যায়। সেখান থেকে হোলসেলারের হাত ঘুরে খুচরো বিক্রেতার মাধ্যমে চাষির কাছে পৌঁছয়। এই তিন হাত ঘুরে মাল ওঠানামার পর, তাকে গাড়িতে করে আনা-নেওয়া করার খরচ সারের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে দাম সামান্য বাড়ে। আমরা সাংগঠনিক ভাবে কৃষিদফতরের সঙ্গে একযোগে কাজ করছি, যাতে সুযোগ সন্ধানীদের তৈরি সমস্যা কাটিয়ে চাষিরা ঠিক দামে সার পান।” পাশাপাশি ভবানীবাবুর অভিযোগ, “সার বিক্রেতারা বিশ বছর আগেকার মতো এখনও একই হারে কমিশন পান। এ ক্ষেত্রে সরকারি নীতির কোনও বদল হয়নি। এ নিয়ে বারবার আন্দোলন করেও কোনও ফল হয়নি। এ সব নিয়ে ভাবার সময়ও এসেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debashis bandyopadhyay nabadwip urea
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE