সন্ধ্যের নমাজ শেষ করেই হন্তদন্ত হয়ে পাড়ার মোড়ের দিকে হাঁটছিলেন কুরচিপোতার বছর তিরিশের যুবক সাজ্জিত শেখ। রাতের মধ্যেই শহরের পটুয়াপাড়ায় প্রতিমা বায়না করে আসতে হবে। না হলে ভাল প্রতিমা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তার উপর প্রতিমার চাহিদা বেশি থাকলে পরের দিকে প্রতিমার দামও বেশি পড়তে পারে। এমনিতেই এ বার কালীপুজোর পরপরই জগদ্ধাত্রী পুজো। চাঁদার বাজারও মন্দা। পাড়ার লোকেরাই এ বার তেমন হাত খুলে চাঁদা দিতে চাইছেন না। তবুও কিছুতেই পুজো বন্ধ হতে দেবেন না সাজ্জিত শেখ, করিম খান, হাসান খানরা।
দীর্ঘ দিনের পুজো। প্রথম দিকে এলাকার কয়েক জন পুজোটা শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘নিউ ক্লাবের’ পুজোর দায়িত্ব এসে পড়েছে তাঁদের উপরেই। তাই ঈদের মতোই সমান উৎসাহে এ বারেও জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন করেছেন তাঁরা। এই পুজো কমিটির প্রায় নব্বই ভাগ কর্মকর্তা মুসলিম সম্প্রদায়ের। তাঁদের মোটা টাকা চাঁদাও দেন এলাকার মুসলিমরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ক্লাবের প্রতিমারও নামকরণ করা হয়েছে। ‘সম্প্রীতি মা’।
শুধু নামেই নয় এই ক্লাবের পুজো যে সত্যিকারের সম্প্রীতির পরিবেশে হয় সে কথা এক বাক্যে স্বীকার করে নেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দারাও। কিন্তু শুধুই কি কুরচিপোতার নিউ ক্লাব? না, জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে বছরের পর বছর ধরে গোটা শহরই যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। লক্ষ মানুুষের ভিড়ে কৃষ্ণচন্দ্রের এই শহর যেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের মিলন মেলা হয়ে ওঠে।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভুলে সকলেই মেতে ওঠেন এই বিরাট উৎসবে। পুজো কমিটিগুলির পাশাপাশি এই জগদ্ধাত্রী পুজোতে যোগ দেন সব ধর্মের মানুষ। নাওয়া খাওয়া ভুলে চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন জোগাড়, প্রতিমা আনা থেকে মণ্ডপসজ্জার কাজ সবই তো তাঁরাই সামলান। আবার ঘট বিসর্জনের শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে প্রতিমা বিসর্জনের ‘সাঙ’ ধরা সবকিছুতেই সবার উপস্থিতি জানান দেয় কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী আসলে মহামানবের উৎসব হয়ে উঠেছে।
এই দেশেই শুধু নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানান ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে যখন বারবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিপন্ন হয়েছে তখন কিন্তু এই উৎসবকে ঘিরে নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছে কৃষ্ণনগর। কোনও অবস্থাতেই এই সম্প্রীতির অবস্থান থেকে এতটুকু টলানো যায়নি এই শহরকে।
কৃষ্ণনগর পুরসভার পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বলছেন, “আমাদের শহরের এই উৎসব আসলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মিলন উৎসব। এমন অনেক পুজো কমিটি রয়েছে যার সম্পাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন মুসলিম কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। বর্ধমানের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার পরে চারিদিকে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তার কোনও প্রভাবই কিন্তু আমাদের এই শহরে পড়েনি। পুজোর জৌলুসের পাশাপাশি এটাও কিন্ত আমাদের কাছে অন্যতম গর্বের বিষয়।”
শহরের অন্যতম প্রাচীন কুরচিপোতা বারোয়ারির অন্যতম কর্মকর্তা প্রবীর বসু বলেন, “আমাদের পাড়ায় অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন। তাঁদের অনেকেই আমাদের বারোয়ারির সদস্য। পুজোর আয়োজনে তাঁরা কিন্তু সমান ভাবে সক্রিয় থাকেন। আর এটা হয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরেই।”
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে এই শহরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়েছিল। তার পরে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় এই পুজো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই শহরের মানুষ মনে করেন আবেগ আর উন্মাদনায় এই শহরের থেকে অন্যরা অনেকটাই পিছিয়ে। জগদ্ধাত্রী পুজো যত এগিয়ে আসে ততই যেন ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এই শহরের মানুষ। উৎসবের দিনগুলিতে আয়োজনের এতটুকু ঘাটতি রাখতে চান না তাঁরা। যেন আলোর বন্যায় তাঁরা ভাসিয়ে দিতে চান গোটা শহরকেই। আর সেই আলোর ছটা আছড়ে পড়ে শহরের প্রতিটি কোনায়। প্রতিটি ঘরে। উৎসবের আনন্দে, আলোর বন্যায় ভেসে যায় গোটা শহর।
নিউ ক্লাবের অন্যতম উদ্যোক্তা করিম শেখ বলেন, ‘‘আরে মশাই উৎসবের আবার কোনও রং হয় নাকি? উৎসব তো সকলের। সেই কোন ছোটবেলা থেকে এমনটাই জেনে এসেছি।” তিনি বলেন, ‘‘আসলে এই উৎসবে সকলেই মেতে ওঠেন। কেউই এর বাইরে থাকতে পারেন না।”
প্রতি বছরই গোটা পরিবার নিয়ে সারা রাত মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখেন কৃষ্ণনগরের মাইকেল বিশ্বাস। ভাসানের দু’দিন গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখেন তিনি। কোনও কোনও বার বন্ধুদের সঙ্গে বিসর্জনের শোভাযাত্রাতেও বেরিয়েছেন তিনি।
এ বারেও যে তার কোনও ব্যতিক্রম হবে না তা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়ে মাইকেল বলেন, “ছেলেবেলা থেকেই আমরা কোনও দিনই এই উৎসবটাকে আলাদা ভাবে দেখিনি। নিজেদের উৎসব জেনেই বড় হয়েছি। আজও তাই উৎসবের দিনগুলিতে বাড়িতে থাকতে পারি না। বেরিয়ে পড়ি।” এ ভাবেই মাইকেল বিশ্বাস, করিম খানদের হাত ধরে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো প্রকৃত অর্থেই হয়ে ওঠে সবার, সর্বজনীন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy