Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

কেউ ব্যস্তসমস্ত, কারও ছুটির মেজাজ

এক গ্লাস জলে পাঁচ চামচ ছোলার ছাতু, দু’চামচ মধু। সঙ্গে পাতিলেবুর রস। শুক্রবার সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এই ছিল তাঁর প্রাতঃরাশ। তার আগেই স্নান, পুজোপাঠ সেরে ফেলেছেন। বিজেপির নদিয়া জেলা সভাপতি কল্যাণ নন্দী যখন বাড়ি থেকে বেরোলেন তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় আটটা। তবে ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙেছিল কৃষ্ণগঞ্জের ২৩৪ নম্বর বুথের দলীয় এক কর্মীর ফোনে, “দাদা রাতে ওরা বুথ অফিসের পতাকা, ফেস্টুন সব খুলে ফেলে দিয়েছে।” তার পর থেকে মোবাইলটা আর বিশ্রাম পায়নি।

কল্যাণ নন্দী এবং গৌরীশঙ্কর দত্ত (ডানদিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

কল্যাণ নন্দী এবং গৌরীশঙ্কর দত্ত (ডানদিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনিরুল শেখ
নবদ্বীপ ও কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৫
Share: Save:

এক গ্লাস জলে পাঁচ চামচ ছোলার ছাতু, দু’চামচ মধু। সঙ্গে পাতিলেবুর রস। শুক্রবার সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এই ছিল তাঁর প্রাতঃরাশ। তার আগেই স্নান, পুজোপাঠ সেরে ফেলেছেন। বিজেপির নদিয়া জেলা সভাপতি কল্যাণ নন্দী যখন বাড়ি থেকে বেরোলেন তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় আটটা। তবে ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙেছিল কৃষ্ণগঞ্জের ২৩৪ নম্বর বুথের দলীয় এক কর্মীর ফোনে, “দাদা রাতে ওরা বুথ অফিসের পতাকা, ফেস্টুন সব খুলে ফেলে দিয়েছে।” তার পর থেকে মোবাইলটা আর বিশ্রাম পায়নি।

কৃষ্ণনগর কোতোয়ালি থানার ঠিক উল্টো দিকের বিজেপির দফতরের কল্যাণবাবু যখন এলেন, সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য কমিটির সদস্য জয়ন্ত চক্রবর্তীরা। প্রতাপবাবুর ডায়েরিতে তত ক্ষণে জমে উঠেছে নতুন নতুন অভিযোগের তালিকা। বেতনা গোবিন্দপুরে ১৬৭, ১৬৮ নম্বর, কৃষ্ণগঞ্জের ৭৯, ৮০ নম্বর বুথে, দক্ষিণপাড়া নবযুগ কো-অপারেটিভ গার্লস হাইস্কুলের কোথাও বিজেপির এজেন্টদের বের করে দিয়েছে, কোথাও হুমকি দেওয়া হয়েছে। সব শুনতে শুনতে গাড়িতে উঠে পড়লেন কল্যাণবাবু। কর্মীদের উদ্দেশে বললেন, “গণ্ডগোলের বুথগুলোয় আমি যাব। খবর পেলেই আমাকে জানাবে। তোমরা ‘পিসফুল’ এলাকায় থাকবে। ঝুঁকি নেবে না।”

বিজেপি পার্টি আফিসের সামনে থেকে কল্যাণবাবুর দুধসাদা স্করপিও ছুটল বেতনা গোবিন্দপুরের দিকে। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে ৮টা বাজে। গোবরাপোতা, চিত্তশালি, কুলগাছি হয়ে তাঁর গাড়ি বাঁক নিল গোবিন্দপুরের দিকে। সকাল ৯টা ১৫। কল্যাণবাবু হাঁসখালির গোবিন্দপুর কলোনিতে পৌঁছতেই ছুটে এলেন বেতনা গোবিন্দপুরের বিজেপি অঞ্চল সভাপতি পরিমল বিশ্বাস। জানালেন, বুথক্যাম্প ভাঙচুর, পতাকা-ফেস্টুন ছেঁড়া কিছুই বাকি রাখেনি তৃণমূল। শেষে ১৬৭ নম্বর বুথ থেকে এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। হাঁসখালি গোবিন্দপুর কলোনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন ভোটের লাইনে সাকুল্যে জনা পনেরো লোক। বুথ থেকে সিকি মাইল দূরে গাড়িতে বসে আধঘণ্টার মধ্যে বিজেপির এজেন্টকে বুথে বসিয়ে ফের ছুটল সাদা স্করপিও। গন্তব্য লোকনাথপুর।

ঘড়িতে তখন দশটা। বিজেপি জেলা সভাপতি বলছিলেন, “গত লোকসভা ভোটে কৃষ্ণগঞ্জে ২৮৮টি বুথের মধ্যে আমরা ৪৪টি বুথে লোক দিয়েছিলাম। এ বার সেই চিত্র অনেকটাই পাল্টেছে। প্রায় সমস্ত বুথে আমরা শুধু এজেন্টই দিইনি, বুথ অফিসেও পর্যাপ্ত লোক ছিল।”

১১.১৫ মিনিট। গাড়ি থামল কুটিরপাড়া ‘ফালতু গর্তের’ ধারে। চায়ের দোকানে আদা দেওয়া লিকার চা খেতে খেতেই খবর এল বেড়েরপাড়ায় বিজেপির কর্মী সমর্থকদের ঢুকতে দিচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে ছুট। ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু জেনে নিয়ে নদিয়ার কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষককে বিষয়টি জানাতে বললেন কৃষ্ণনগরে দলীয় কন্ট্রোল রুমে থাকা কর্মীদের। কিছুক্ষণ অপেক্ষা। ছয় গাড়ি পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী হাজির। কর্মীদের মুখে চাওড়া হাসি। ব্যাপার দেখে এলাকার এক বৃদ্ধ বলে বসলেন, “দেখেছ কাণ্ড! এখন কী আর সেই আগের বিজেপি আছে গো!”

দুপুর বারোটা পনেরো নাগাদ গাড়ি ছুটল বগুলা কুঠিপাড়া, রেলগেট, গাড়াপোতা হয়ে বাথানগাছি। শেষে পিপুলবেড়িয়া হয়ে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা রাস্তা দিয়ে ফতেপুর। ফতেপুরের বুথ ছুঁয়ে গাড়ি ছুটল গাজনা। গাজনা কৃষ্ণগঞ্জের সব থেকে বড় পঞ্চায়েত। গাজনা চষে দুপুরের খাওয়ার জন্য কল্যাণবাবু থামলেন শিবনিবাসে। তখন দুপুর আড়াইটে।

লাঞ্চের মেনু ডাল, বেগুন ভাজা, আলু দিয়ে রুই মাছের কালিয়া, চাটনি আর মাজদিয়ার খেজুরের গুড়ের রসগোল্লা। বিকেল নাগাদ গাড়ি ছুটল কৃষ্ণনগরে দলীয় কার্যালয়ে দিকে। পাঁচটায় ভোট শেষ। খবর এল ৮২ শতাংশ ভোট পড়েছে। কল্যাণবাবু বলেন, “মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন এতেই আমি খুশি। এই কদিন মাত্র দু’ঘণ্টা করে ঘুমিয়েছি। তার ফল, মানুষ ভোট পেরেছেন, যেটা আমরা চেয়েছিলাম। বাকিটা ১৬ তারিখের জন্য তোলা থাক।”

অন্য দিকে, কৃষ্ণনগরের জেলা দফতরে সারাদিন কার্যত ছুটির মেজাজে কাটালেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দফতরে বসে কর্মীদের সঙ্গে গল্পগুজব করলেন। এ দিন সকাল আটটার মধ্যেই দলীয় কার্যালয়ে এসে এক কর্মীকে চিনি ছাড়া লাল চা পাঠাতে বলেন। চা খেতে খেতে খাতা-পেন নিয়ে শুরু হল অঙ্ক কষা। কর্মীদের বললেন, “চিন্তা করিস না। আমরাই জিতব।”

সকাল থেকে গৌরীবাবুর মোবাইলে ঘনঘন ফোন এসেছে রাজ্য নেতাদের। সকলকে তিনি প্রায় কলার টিউনের ঢঙে বলে গেলেন, “আরে সংগঠন খুব মজবুত। ভোটও ভাল পড়ছে। আমরাই জিতব।” বেলা এগারোটা নাগাদ প্রশ্নটা আর না করে আর থাকা গেল না। মুকুল রায় ফোন করেননি? গৌরীবাবুর গম্ভীর উত্তর, “না, এখনও আসেনি।” দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশেও তাঁর একই পরামর্শ, “মাথা ঠাণ্ডা করে ভোট করা। অহেতুক গোলমালে জড়াস না।”

বারোটা নাগাদ দলীয় দফতরের দু’টি কামরায় কর্মীদের সমাবেশে গমগম করতে শুরু করে। গৌরীবাবুর সামনে সবুজ রঙের খান দশেক চেয়ারে নেতা-কর্মীরা হাঁ করে বসে টিভির পর্দায় নজর রাখছিলেন। গৌরীবাবুও বিভিন্ন চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “আমরা জিতব। বিজেপির সেই সংগঠন নেই।’’ বেলা এগারোটা নাগাদ ভোট পড়ার হার নিয়ে খোঁজখবর নিলেন। ফোন করলেন জেলা প্রশাসনের এক কর্তাকে। তখন ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। কর্মীদের বললেন, ‘‘ভোট পড়ার হার এত কম কেন? আমাদের লোকেরা ঠিকঠাক ভোট দিতে আসছে তো?’’ পরের ফোন গেল দলীয় প্রার্থী সত্যজিৎ বিশ্বাসের কাছে। আদেশের সুরে বললেন, ‘‘সত্য ভোটটা একটু তাড়াতাড়ি করা বাবা।’’

উপনির্বাচনে ভোট বেশি পড়ার অর্থ তো বেশিরভাগ সময় তা যায় শাসকদলের বিরুদ্ধে। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে গৌরীবাবু বললেন, “সব ভোটারই আমাদের লোক। বেশি ভোট পড়ার অর্থ হল জয়ের ব্যবধান বেশি হওয়া।”

এরই মধ্যে অভিযোগ ওঠে, একটি বুথে দলীয় প্রার্থী সত্যজিৎ বিশ্বাস প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন ভোটারদের। জানতে পেরেই প্রার্থীকে বললেন, “মোবাইল আছে, দলের কর্মীরা আছে। নিজের কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।” বেলা দু’টো নাগাদ ভাত আর মুরগির মাংস দিয়ে সারা হল লাঞ্চ। খাওয়া শেষ হলে টেবিলে মাথা দিয়ে একটু দিরিয়ে নেওয়া। এরই ফাঁকে এক কর্মী পান এনে দিলেন। পান চিবোতে চিবোতে বললেন, “পানটা বেড়ে বানিয়েছে রে।’’

বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ খবর এল ভোট পড়েছে প্রায় আশি শতাংশ। বেলা সাড়ে চারটা নাগাদ গৌরীবাবু বললেন, ‘‘খেলা প্রায় শেষ। এ বার ফলের অপেক্ষা।’’ বিকেলে সোয়া পাঁচটা নাগাদ দলবল নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন গৌরীশঙ্কর দত্ত। প্রার্থীকে আশ্বস্ত করলেন, “চিন্তা করিস না রে। তুই বিধানসভায় যাবি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE