দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো সেরে গোটা বাংলা যখন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। আবার শুরু হয়েছে অফিস কাছারি যাওয়ার তাড়া। ঠিক তখনই কৃষ্ণনগর কিন্তু উঠে পড়ে লেগেছে শক্তি সাধনায়। উৎসাহ দুর্গাপুজোর থেকে বরং কিছুটা বেশিই।
পক্ষ পেরোলেই শুরু হবে জগদ্ধাত্রী পুজো। আর তারই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে শহর জুড়ে। পাড়ায় পাড়ায় একটাই আলোচনা, পুজোর বাজেট কেমন হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চড়া দাম নিয়ে নাজেহাল আম আদমি। এই পরিস্থিতিতে কেমন ভাবে বজায় রাখা সম্ভব হবে ঐতিহ্যের জগদ্ধাত্রী পুজো, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। তাই ঘন ঘন বৈঠকে বসছেন পুজো উদ্যোক্তারা। মণ্ডপ, আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে প্রতিমা সব কিছুকে সাধ্যের মধ্যে বেঁধে রাখাই উদ্দেশ্য। প্রায় সকলেই চাইছেন পুজোর বাজেট কিছুটা কম করতে।
পুজো উদ্যোক্তাদের অনেকেই বলছেন, এই এক বছরে যে ভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে প্রতিবারের মতো এবারেও পুজোর জৌলুস রক্ষা করতে গেলে বাজেট এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। সেই বিরাট পরিমাণ টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা। চাঁদা তোলার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে তাই ইতিমধ্যেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পুজোর আয়োজনে কাটছাঁট করে সাবেকি জৌলুস বজয়া রাখতে চাইছেন প্রায় সকলেই। আবার অনেক উদ্যোক্তা যাঁদের ক্ষমতা কিছু বেশি, তাঁরা ঝুঁকি নিচ্ছেন। এ বছরের পুজো বাজেট বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কৃষ্ণনগরের প্রধান পুজোগুলোর মধ্যে চাষাপাড়া বারোয়ারি ‘বুড়িমা’-র পুজো অন্যতম। আড়ম্বর আর নিষ্ঠা দু’য়ের মিশেলেই প্রতিবার অন্যকে টেক্কা দিয়ে যায় এই পুজো। পুজো কমিটির সম্পাদক গৌতম ঘোষ বলেন, “জৌলুস কম করার কোনও প্রশ্নই নেই। বরং এ বার আমাদের বাজেট বেড়েছে প্রায় তিন লক্ষ টাকা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজেটও বেড়ে চলেছে।” বুড়িমা-র পুজোর বেশির ভাগ খরচই নাকি উঠে আসে দেবীর প্রণামী থেকে। কিন্তু অন্যরা কী করবেন?
শহরের আর একটি জনপ্রিয় পুজোর হাতারপাড়া বারোয়ারি। দুর্গাপুজোর অনেক আগে মহালয়ার দিনই বৈঠক করে পুজোর বাজেট তৈরি করে ফেলেছে তারা। গতবার এই পুজোর বাজেট ছিল প্রায় ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। এবার সেটা বেড়ে দাঁড়িয়ে হয়েছে প্রায় ৮ লক্ষে। পুজো কমিটির কার্যকরি সভাপতি তথা এলাকার কাউন্সিলর তৃণমূলের দিলীপ বিশ্বাস বলেন, “ডাকের সাজ থেকে শুরু করে মণ্ডপ, আলোকসজ্জা সব কিছুতে খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে বেড়েছে তাতে হয় পুজো ছোট করতে হবে না হলে বাজেট বাড়াতেই হবে। বাধ্য হয়েই আমরা তাই বাজেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি সেই টাকা তুলে আনাটাও এখন পুজো কর্তাদের কাছে একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ। অন্যতম বড় এক পুজো কমিটির এক কর্তার কথায়, “আবেগের বসে আমরা হয়ত বাজেট বাড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমরা এখনও জানিনা ওই বিরাট পরিমান টাকা কোথা থেকে আসবে। হয়ত এবার বাজারে কিছু টাকা দেনা থেকে যেতে পারে।”
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উদ্যোগে শুরু জগদ্ধাত্রী পুজোর। দেশে বিদেশে পুজো ঘিরে খ্যাতি ছড়িয়েছে কৃষ্ণনগরের। জাঁকজমক আর উন্মাদনায় এই শহর বারাবরই পাল্লা দিয়ে এসেছে চন্দননগরের সঙ্গে। পুজোর টানে প্রতিবছরই জেলার বাইরে থেকেও হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমায় এই শহরে। সারা রাত ধরে শহরের রাজপথে উপচে পড়ে লক্ষ মানুষ ভিড়। পুজোর আগের দিন থেকে প্রতিমা নিরঞ্জনের দু’দিনই জনশ্রোতে ভেসে যায় এই শহরের রাস্তাঘাট।
শহরের ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারি পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম গোলাপট্টি বারোয়ারি। সেই ঐতিহ্যের ধারবাহিকতা বজায় রখাতে তারাও এবার বহু টাকার বাজেট বাড়িয়েছেন। পুজো কমিটির সম্পাদক তৃণমূল কাউন্সিলর অয়ন দত্ত বলেন, “আমাদের পুজোর বৈশিষ্টই হল নতুনত্ব। এবারও আমরা তার ব্যতিক্রম নেই। মধুবনী পটচিত্রের মাধ্যমে মণ্ডপ তৈরি করছি এ বছর। বাজেট কিছুটা তো বেড়েছে বটেই।”
গত বছর এই বারেয়ারীর বাজেট ছিল প্রায় ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। এবার সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ টাকায়। কিন্তু এত টাকা আসবে কোথা থেকে? জানা গিয়েছে একটি অভিনব ব্যপার। এ বছর পাড়ায় যাঁরা নতুন চাকরি পেয়েছেন তাঁরা বেশি করে চাঁদা দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। বাকিটা বিজ্ঞাপন ভরসা। কিন্তু তাতেও কর্তারা সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত হতে পারছেন কই!
সব পুজো কমিটিই যে বাজেট বাড়িয়েছেন, তেমনটা কিন্তু নয়। বিশেষত ছোট পুজো গুলি বেশ সংকটে। কৃষ্ণনগরের প্রান্তিক জনবসতি হল ঘূর্ণি। এখানকার বিখ্যাত শিল্পীরা তাঁদের শিল্প সত্ত্বা দিয়ে মণ্ডপকে আকর্ষণীয় করে তোলেন। তাই বরাবরই এখানকার পুজো গুলি অপেক্ষাকৃত স্বল্প বাজেটের। তবু ঘূর্ণি অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু এ বছর তারা কিন্তু খুব একটা স্বস্তিতে নেই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধাক্কা লেগেছে তাদের পুজোতেও। এদের অন্যতন ঘূর্ণি বারোয়ারির অন্যতম উপদেষ্টা তৃণমূল কাউন্সিলর গৌতম রায় বলেন, “বাজেট আমরা খুব একটা বাড়াতে পারিনি। এমনিতেই চড়া বাজার দরে নাজেহাল মানুষ। তার উপরে কী করে আবার আমরা চাঁদার জন্য চাপ দিই! তবু নয় নয় করেও বাজেট বেড়েছে প্রায় ১৮ হাজার টাকা।”
পুজোর আগে বাজেট নিয়ে বেশ চিন্তায় গোটা কৃষ্ণনগর। তবে প্রস্তুতি চলছে পুরদমে। শ্রেষ্ঠ উৎসবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে দিতে পিছপা নয় কৃষ্ণনগর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy