Advertisement
E-Paper

তৃণমূলের সভায় গেল না ঘুঘড়াগাছি

মুখ ফিরিয়ে থাকলেন এলাকার সিংহভাগ বাসিন্দা। সভা ভরালেন বহিরাগতরা। শুক্রবার কৃষ্ণগঞ্জের জঘাটায় সভা করতে গিয়ে তৃণমূলের প্রাপ্তি বলতে এইটুকুই! রবিবার ঘুঘড়াগাছিতে জমি দখলকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা অপর্ণা বাগ। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও তিন জন। সেই ঘটনায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা-সহ অন্যান্য দুষ্কৃতীদের মদতদাতা হিসাবে জড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরীর নাম।

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০১:২৬
বক্তব্য রাখছেন লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

বক্তব্য রাখছেন লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

মুখ ফিরিয়ে থাকলেন এলাকার সিংহভাগ বাসিন্দা। সভা ভরালেন বহিরাগতরা।

শুক্রবার কৃষ্ণগঞ্জের জঘাটায় সভা করতে গিয়ে তৃণমূলের প্রাপ্তি বলতে এইটুকুই!

রবিবার ঘুঘড়াগাছিতে জমি দখলকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা অপর্ণা বাগ। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও তিন জন। সেই ঘটনায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা-সহ অন্যান্য দুষ্কৃতীদের মদতদাতা হিসাবে জড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরীর নাম। সংবাদমাধ্যমে সে কথা প্রকাশ হতেই রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে শাসক দল। ঘটনার পরের দিন, সোমবার মাজদিয়া ও কৃষ্ণগঞ্জের খালবোয়ালিয়া মোড়ে তৃণমূল সভা করলেও এত দিন গ্রামে ঢোকার ‘সাহস’ পায়নি তারা। এ দিনও গ্রামের ভিতরে না ঢুকে গ্রামের বাইরে, জঘাটা মোড়ে মঞ্চ করে সভা করল তৃণমূল!

কিন্তু যাঁদের জন্য এই সভার আয়োজন, তাঁরাই এ দিন সভা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যে অপর্ণাদেবীর খুনের প্রতিবাদে এ দিনের সভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেই অপর্ণা বাগের স্বামী ও ছেলেমেয়েরা এ দিন সভায় আসেননি। আসেননি জখমদের পরিবারের কোনও সদস্যও। আর আহত ও নিহতদের পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলের সেই সভা বয়কট করে যেন নীরব প্রতিবাদ জানাল গোটা ঘুঘড়াগাছি।

স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সেই অনুরোধে কেউ সাড়া না দেওয়ায় শাসক দলে অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। ২২ বিঘা জমি যে ৫৬ টি পরিবার চাষ করছেন তাঁরাও কেউ এ দিনের সভায় যাননি বলে দাবি করেছেন গ্রামের বাসিন্দারা। যদিও তৃণমূলের দাবি, তাদের সভায় এসেছিল এগারোটি পরিবার।

এ দিন দুপুর থেকেই বাড়িতে ছিলেন না নিহত অপর্ণা বাগের স্বামী দেবানন্দ বাগ ও ছেলে দীপঙ্কর বাগ। প্রতিবেশীদের দাবি, পাছে তৃণমূলের সভায় যেতে হয় সেই ভয়ে তাঁরা সকলেই দুপুরের পরে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন। সভা শেষ হলেই তবে বাড়িতে ফিরেছেন। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে অপর্ণাদেবীর বড় মেয়ে নীলিমা বাগ বলে, “ওদের সভায় কেন যাব বলতে পারেন? ওরাই তো আমার মাকে মেরেছে। ওরা পারবে , আমার মাকে ফিরিয়ে দিতে?” রীতিমতো ক্ষোভের সঙ্গে নীলিমা বলে, “ঘটনার পরে সকলেই এসেছিলেন। শুধু তৃণমূলের লোকজনই আসেননি। একটি বারের জন্যও ওঁরা এসে জানতে চাননি আমরা কী অবস্থায় আছি। এখন এসব প্রতিবাদ সভার কোনও মানে হয় না। সবই তো তাঁরা করছেন নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে।” একই কথা জানিয়েছেন শ্যমলীদেবীর স্বামী উত্তমবাবুও ও আহতদের পরিবারের সদস্যরাও।

এ দিন তৃণমূলের ওই প্রতিবাদ সভায় যখন লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরীর নাম ঘোষণা করা হচ্ছে তখনও উত্তমবাবু গ্রামের রাস্তার পাশে চুপ করে বসেছিলেন। উত্তমবাবু বলেন, “ওরা আমাকে সভায় যেতে বলেছিল। কিন্তু আমি যাইনি। যাবও না। একবার জমির জন্য ওদের পিছনে ঘুরে এই বিপদ হল। এরপর সভায় গেলে না জানি আরও কত বড় বিপদ হবে।” তাঁর কথায়, “একবারও তো কেউ এসে জিজ্ঞাসা করল না যে, আমার স্ত্রীর কী ভাবে চিকিৎসা চলছে। কোথা থেকে টাকা জোগাড় করছি। এখন নিজেদের দোষ ঢাকতে এই সভা করছে তৃণমূল। এ সব জানার পরে আর ওদের ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।”

এ দিন ঘুঘড়াগাছির লোকজন যে এমনটা করতে পারে তা আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন তৃণমূলের নেতারা। আর সেই কারণেই অন্য গ্রাম থেকেও লোকজন আনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ দিন তৃণমূলের সভা ভরিয়েছে সেই বহিরগতরাই। আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লছিমন ও ম্যাটাডোর বোঝাই করে লোকজন আসতে শুরু করেছিলেন দুপুর থেকেই।

রবিবারের ঘটনার পরে কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন থেকে শুরু করে একে একে সব দলই ভিড় করেছে এই গ্রামে। সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে শুরু করে বিমান বসু, বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য সকলেই দফায় দফায় এই গ্রামে এসে সভা করেছেন। নিহত ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে সিপিএম। কিন্তু এত কিছুর পরেও ঘুঘড়াগাছি গ্রামে পা পড়ল না কোনও তৃণমূল নেতার। এ দিনও জঘাটা মোড়ে সভা করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেন ব্লক থেকে শুরু করে জেলা তৃণমূলের নেতারাও।

কিন্তু গ্রামের এত কাছে সভা করলেও নেতারা গ্রামে ঢুকলেন না কেন? কেন তাঁরা এ দিনও নিহত ও আহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেন না? তার অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি ব্লক ও জেলা তৃণমূলের কোনও নেতার কাছেই। বক্তব্য রাখতে দিয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করে বলেন, “সংবাদমাধ্যম আমাদের বিরুদ্ধে যত লিখবে তত আমাদের লাভ। আমরা সঠিক বলে প্রমাণিত হব। আমাদের নেতা লক্ষ্মণের সৌভাগ্য যে, সংবাদমাধ্যমে তাঁর সমালোচনা হচ্ছে।” ওই ২২ বিঘা জমির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এ বার যদি কেউ ওই জমি দখল করতে আসে তাহলে তার হাত কেটে নেব। মাথা গুঁড়িয়ে দেব।”

তিনি বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, শমীক ভট্টাচার্যকে শকুন বলে কটাক্ষ করেন। কিন্তু কেন তৃণমূল গ্রামে ঢুকল না তা নিয়ে স্পষ্ট করে তৃণমূলের তরফে কোনও উত্তর মেলেনি। যা নিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষ, “যাবে কোন মুখে? গ্রামে গিয়ে তো মিথ্যা বলতে হত। তাতে বিক্ষোভের মুখে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কে আর যেচে অপমানিত হতে যায়!”

তবে এ দিনের সভায় বক্তব্য রাখতে দিয়ে লক্ষ্মণবাবু বলেন, “আমার রাজনীতিতে আসাটাই ভুল হয়েছে। ভদ্রলোকের রাজনীতিতে আসা উচিত নয়। ওরা (সংবাদমাধ্যম) শেষ পর্যন্ত আমাকে গরু পাচারকারী বানিয়ে দিল!” সেই সঙ্গে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘‘আমি চাই দুষ্কৃতীদের চরম সাজা হোক। এ দিনের সভায় ক্ষতিগ্রস্তরা আসুক বা না আসুক আমরা ওঁদের পাশে আছি।”

দূর থেকে মাইকে সে কথা শুনে ঘুঘড়াগাছির নরেন ধারা, শান্তিময় মণ্ডলরা বলছেন, “এ সব কথা শুনলে ঘোড়াতেও হাসবে।’’ জমির জন্য লড়াই করা ঘুঘড়াগাছির মানুষ ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাননি। বরং প্রতিবাদটা আজও করে চলেছেন। নিজেদের মতো করে।

ghugragachi krishnaganj tmc convention land dispute
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy