Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

থিম-পুজো আর লোকগানে মেতেছে তেহট্ট

এই সেই সময় যখন ঘরের ছেলেরা ঘরে ফেরে। এই সেই সময় যখন আত্মীয়দের ভিড়ে গমগম করে সকলের বাড়ি। এই সেই সময় যখন উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নিতে চান সকলেই। জগদ্ধাত্রী পুজোর এই সময়টার জন্যই তো প্রতি বছর অপেক্ষায় থাকে তেহট্ট। বেশ কয়েক বছর ধরে তেহট্টের অন্যতম বড় উৎসব জগদ্ধাত্রী পুজো। আর সেই উৎসবকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করে তুলতে নাওয়া খাওয়া ভুলেছেন পুজো উদ্যোক্তারা।

মহাষ্টমীতে তেহট্টে চলছে আরতি (বাঁ দিকে)। অন্য একটি মণ্ডপের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র

মহাষ্টমীতে তেহট্টে চলছে আরতি (বাঁ দিকে)। অন্য একটি মণ্ডপের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র

কল্লোল প্রামাণিক
তেহট্ট শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০২:১৭
Share: Save:

এই সেই সময় যখন ঘরের ছেলেরা ঘরে ফেরে। এই সেই সময় যখন আত্মীয়দের ভিড়ে গমগম করে সকলের বাড়ি। এই সেই সময় যখন উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নিতে চান সকলেই। জগদ্ধাত্রী পুজোর এই সময়টার জন্যই তো প্রতি বছর অপেক্ষায় থাকে তেহট্ট।

বেশ কয়েক বছর ধরে তেহট্টের অন্যতম বড় উৎসব জগদ্ধাত্রী পুজো। আর সেই উৎসবকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করে তুলতে নাওয়া খাওয়া ভুলেছেন পুজো উদ্যোক্তারা। জিৎপুর সেমনেস বয়েজ ক্লাবের সদস্য ও পুজো কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক নির্মাল্য বিশ্বাস বলছেন, “বছর পনেরো আগে আমরা জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটাই এখন আমাদের সবথেকে বড় উৎসব। এ বছর আমাদের প্রতিমা এসেছে কৃষ্ণনগর থেকে। প্রতি বছরের মতো আলোকসজ্জায় নজর কাড়বে পুজো মণ্ডপ।”

তেহট্টে এ বছর মোট পুজোর সংখ্যা প্রায় ষাট ছাড়িয়েছে। এলাকার জনপ্রিয় পুজোগুলোর মধ্যে বর্গিডাঙাপাড়া যুব সঙ্ঘের পুজোতে এ বার রয়েছে কিছু বিশেষ আকর্ষণ। পুজো কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা সঞ্জয় মোহান্তি বলেন, “আমাদের থিম যমপুরি। একটি মণ্ডপের মধ্যে থাকবে পাহাড়ি দৃশ্য। সেখানে ১২ জন শিল্পী অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরবে যমপুরির নানা ঘটনা। অন্য দিকে কাটোয়া থেকে আনা আলোকসজ্জায় দেখানো হবে মহাভারতের দৃশ্য, থাকবে মণীষীদের ছবি আর ছোটদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে টম অ্যান্ড জেরি।”

দশ বছরের পুরনো তেহট্ট ঠাকুরপাড়া বারোয়ারি পুজো কমিটির সম্পাদক জ্যোৎস্না বিশ্বাস বলেন, “কয়েক বছর পরে এ বার আবার আমরা শুধু মহিলারাই এই পুজোর আয়োজন করেছি। আমাদের পুজো মণ্ডপে আলোর মাধ্যমে দেখানো মানুষের বাল্যকাল থেকে বৃদ্ধাবস্থা। তেহট্ট দত্তপাড়া বারোয়ারির জগদ্ধাত্রী ‘বড়মা’ এ বার পনেরো বছরে পা রাখল। পুজো কমিটির সম্পাদক সৈকত ভট্টাচার্য বলেন, “১৬ বছর আগে এই পুজো শুরু হয়েছে। সেই প্রথম পুজোর কাঠামোতেই প্রতি বছর প্রতিমা তৈরি হয়। দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন কাঠামোতে মাটি দেওয়া হয়। পুজোর ক’দিন মণ্ডপে চণ্ডীপাঠ চলে।”

তেহট্ট সিনেমাহল পাড়া বারোয়ারির সদস্য শমিত বিশ্বাস বলেন, “দশমীতে লোকগীতির আয়োজন করা হয়েছে। আলোকসজ্জাও সকলের নজর কাড়বে।” এছাড়াও বিডিও অফিসপাড়া বারোয়ারি, তেহট্ট হাট আমরা সবাই ক্লাব, চাতরপাড়া বারোয়ারি, সোনাপট্টি বারোয়ারি, মণ্ডলপাড়া বারোয়ারি, বাইতিপাড়া বারোয়ারি, ত্রিপুরাপাড়া বারোয়ারি, ক্লাব আবির্ভাব, কালীতলা বারোয়ারি, তেহট্ট হাসপাতালের কাছে ঐকতান ক্লাব, পিডব্লিউডি মোড়ের ক্লাব তিনমূর্তির পুজোও নজর কাড়বে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের।

প্রায় পাঁচশো মিটার রাস্তা জুড়ে আলোয় সেজেছে তেহট্টের গরিবপুর বারোয়ারি। ক্লাব বন্ধন খালের ধারে নানা রকম পুতুল দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে মণ্ডপ। আলোকসজ্জাতে নজর কাড়বে নতুনপাড়া ক্লাব পোলাইট গাইজ ও লাইব্রেরিপাড়া বারোয়ারি। হাই স্কুলপাড়া বারোয়ারি, দাসপাড়া বারোয়ারির পুজো মণ্ডপে এ বছরও ভিড় উপচে পড়বে দাবি উদ্যোক্তাদের। মণ্ডপের পাশাপাশি প্রতিমায় চমক দিতে চান তেহট্ট হাউলিয়া পার্ক মোড়ের ক্লাব ইউনিক-এর সদস্যরা।

ক্লাবের সম্পাদক সুভাষচন্দ্র ঘোষ বলেন, “এর আগে আমরা কখনও পাট, পুঁতি, কাচ, ধান কিংবা ঝিনুক দিয়ে প্রতিমা তৈরি করেছিলাম। এ বার প্রায় ৩২০০ দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে তৈরি করছি জগদ্ধাত্রী প্রতিমা। প্রতি বছরের মতো এ বারেও আমাদের ক্লাবের সদস্যরা নিজেরাই এই প্রতিমা তৈরি করেছেন।”

তেহট্টের মহিলা পরিচালিত ঠাকুরপাড়া বারোয়ারির সভাপতি শ্যামলী রজক বলেন, “গত এক মাস থেকে আমরা এই পুজো নিয়ে ব্যস্ত। বাড়ির কাজ সামলে রোজ চাঁদা সংগ্রহ থেকে শুরু করে পুজোর যাবতীয় আয়োজন আমরা নিজেরাই করছি।”

তেহট্টের চিরঞ্জিৎ প্রামাণিক বলছেন, “সীমান্তবর্তী এই এলাকায় সারা বছর তেমন কোনও বিনোদন নেই। দুর্গাপুজোও হয় হাতেগোনা কয়েকটা। তাই এই জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন তেহট্টের মানুষ।”

হাউলিয়া পার্ক মোড়ের বর্ণালী লাহা, রিতা লাহারা বলছেন, “দুর্গাপুজোর নাড়ু-মুড়কি তো লক্ষ্মীপুজোর মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় আবার নাড়ু-মুড়কি তৈরি করি। এই সময় আত্মীয়দের ভিড়ে বাড়ি গমগম করে। জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় কী যে আনন্দ হয় তা বলে বোঝানো যাবে না।” অঞ্জলি প্রামাণিকের কথায়, “ভিন্দেশ থেকে কতদিন পরে ছেলেরা ঘরে ফিরছে। ওদের জন্য নিজের হাতে নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, ঝুড়ির নাড়ু ও নিমকি তৈরি করেছি।”

তেহট্টের এই জগদ্ধাত্রী পুজোর দিকে তাকিয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরাও। বুধবার রাতেই যেমন তেহট্টে চলে এসেছেন দেবনাথপুরের সুনীল মণ্ডল। বিডিও অফিসের কাছে অস্থায়ীভাবে তিনি একটা রোলের দোকান দিয়েছেন। সুনীলবাবু বলেন, “প্রতিবছর জগদ্ধাত্রীর সময় আমি তেহট্টেই দোকান দিই। পুজোর দিনগুলিতে ব্যবসাও ভাল হয়।” স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী গণেশ হালদার, ধনঞ্জয় মালাকারদের কথায়, “তেহট্ট মহকুমা সদর হওয়ায় কাজের সূত্রে বহু মানুষ এখানে আসেন। তবে পুজোর সময় তেহট্টে ভিড় উপচে পড়ে। সেই কারণে আমরাও প্রস্তুতি নিয়েছি। যাতে কেউ খেতে এসে ফিরে না যান।” মনোহারি ব্যবসায়ী বিনয় আচার্য বলেন, “পুজোর দিনগুলিতে অনেক রাত পর্যন্ত বেচাকেনা চলে।”

তেহট্ট ফেরিঘাটের লিয়াকত আলি মুন্সি বলেন, “দৈনিক গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ জলঙ্গি নদী পার হয়ে যাতায়াত করেন। তবে পুজোর দিনগুলিতে সেই সংখ্যটা পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেড়ে যায়।” তেহট্ট বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুমিত বিশ্বাস বলেন, “এই জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় জমে ওটে ব্যবসা। চাঙ্গা হয় স্থানীয় অর্থনীতি।”

পুজোর দিনগুলিতে যাতে কোনওরকম অপ্রীতির পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে জন্য সতর্ক রয়েছে প্রশাসনও। তেহট্টের এসডিপিও সুনীল সিকদার বলেন, “শনিবার ও রবিবার পুজোর এই দু’দিন তেহট্টের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। খোলা হয়েছে কন্ট্রোলরুম। সোমবার রাত দশটার মধ্যে সমস্ত পুজো উদ্যোক্তাদের বলা হয়েছে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে দিতে।”

তেহট্টের মহকুমাশাসক অর্ণব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নদীতে বিসর্জন দেওয়ার পর প্রতিমার কাঠামোগুলো যাতে তুলে নেওয়া হয় সে বিষয়ে পঞ্চায়েতকে নজর রাখতে বলা হয়েছে।”

তেহট্টের মতো জাঁকজমক করে না হলেও জগদ্ধাত্রী পুজো হচ্ছে করিমপুরেও। করিমপুরের ১ নম্বর ওয়ার্ড বাজার ব্যবসায়ী সমিতির পুজো এ বার ১৯ বছরে পা রাখল। এ ভচর প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন করছে করিমপুর ফার্ম মোড় ঠেক ও ব্যবসায়ীবৃন্দ। আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে রাস্তা। পুজো উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন করছে নাটনা পশ্চিমপাড়া উদয়ন ক্লাব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jagaddhatri pujo tehatta kallol pramanick
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE