রিকশার দাপটে পথচলাই দায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
এক সময়ে জলে জঙ্গলে ভরা থাকলেও দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টেছে শহর রানাঘাটের। ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশেছে আধুনিকতা। এখনও বহু বনেদি পরিবার রয়েছেন রানাঘাট শহরে। বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিরও জন্মভূমি রানাঘাট। সৌভ্রাতৃত্ব, কৃষ্টি, সংস্কৃতির শহরও রানাঘাট। তবুও কোথাও যেন শহরের সেই গৌরবকে কালিমালিপ্ত করে চলেছে শহরের যানজট।
সম্রাট আকবরের আমলে রাজস্ব সচিব রানা টোডরমল রানাঘাটে জমি জরিপ করতে এসেছিলেন। সেই থেকেই জায়গাটির নাম হয় রানাঘাট। তবে এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, এক সময় রানাঘাটে রনা নামক এক দুর্ধর্ষ ডাকাত ছিল। রানাঘাটে তাঁর একটি কালীমন্দিরও ছিল। সেই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির আজও শহরবাসীর গর্বের বিষয়। সেই ডাকাতের নামানুসারে রানাঘাট নামটি এসেছে। এক সময় চূর্ণী নদীকে ঘিরেই এলাকায় জনজীবন শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে রেলপথ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারিত হওয়ায় ক্রমশই এই শহরের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। শহরের বর্তমান আয়তন ৭.৭২ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী শহরের বর্তমান লোকসংখ্যা ৭৫,৩৪৪।
নামকরণের ইতিহাস যাই বলুক না কেন গবেষকদের মতে, রানাঘাটকে আধুনিক শহরে পরিণত করার ক্ষেত্রে পালচৌধুরী পরিবারের অবদান অসামান্য। শিক্ষার প্রসারে স্কুল ও গ্রন্থাগার তৈরি করা, রানাঘাট পুরসভা গঠন-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান রয়েছে। শুরুর দিকে পানের ব্যবসা করলেও পরে তাঁরা বড় ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এমনকী, ব্যবসার জন্য তাঁরা ইংরেজদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। অবশেষে ১৭৯৯ সালে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে তাঁরা রানাঘাট শহরটি কিনে নেন। চূর্ণী নদীর তীরে বাকিংহাম প্যালেসের অনুকরণে প্রাসাদ গড়ে তোলেন। সামনে একটি রাস্তাও তৈরি করেন। যার নাম ছিল শাহী রোড। শহরের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক তাপস বন্দোপাধ্যায় বলেন, “সুরেন্দ্রনাথ পালচৌধুরীর চেষ্টাতেই রানাঘাট পুরসভা তৈরি সম্ভব হয়েছিল। পৌরসভাটিও তাঁরই দান। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই পুরসভার দায়িত্ব পালন করেছেন।” স্বাধীনতার পরেই রানাঘাট শহরের কলেবর বৃদ্ধি হতে শুরু করে। তত্কালীন পূর্ববঙ্গ থেকে বহু উদ্বাস্তু মানুষ শহরের পূর্ব প্রান্তে এসে বসবাস শুরু করেন। আত্মীয়স্বজন ছেড়ে আসার যন্ত্রণা হয় তো দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছিল। তাই সেই থেকে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকার এক সুদীর্ঘ অতীত রয়েছে শহরের। এমনকী, তার আগে থেকেও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। চারণকবি মুকুন্দ দাসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দেশি চুড়ি তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। তারপর থেকেই এলাকারটির নামই হয়ে যায় চুড়িপাড়া। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীল কমিশনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন জমিদার জয়চাঁদ পালচৌধুরী। পরিষেবা ও স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রানাঘাট পুরসভা তৈরি করে। যা রাজ্যের চতুর্থ পুরসভা। প্রথমে ছিল ১৪ জন কাউন্সিলর। বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৯। আসন্ন পুরসভা নির্বাচনে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হতে চলেছে। কয়েকদিন আগে শেষ হয়েছে পুরসভার সার্ধ-শতবর্ষের অনুষ্ঠান।
শতাব্দীপ্রাচীন এই শহরের ইতিহাসও যেমন দীর্ঘ তেমনি বর্তমান নাগরিক পরিষেবা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে অভিযোগের তালিকাও কম লম্বা নয়। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণান্তকর ঘটনা হল শহরের যানজট। রানাঘাট রেলস্টেশন থেকে বেরোলেই সহজেই তা আঁচ করা যায়। ১ নম্বর প্লাটফর্মের জিআরপি গেট পেরিয়ে সড়ক পথে পা রাখলেই পড়তে হবে যানজটের খপ্পরে। জিএনপিসি রোড, সুভাষ অ্যাভিনিউ বা স্বামী বিবেকানন্দ সরণী কোথাও গিয়ে সেই যানজটের হাত থেকে রক্ষে পাওয়ার উপায় নেই। আর স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়ালে চলাফেরা করা তো দূরের কথা, এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত যায় না। রাস্তার দু’পাশের দোকানগুলো যেন দিনে দিনে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসছে। অন্য দিকে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভ্যানো, রিকশার দাপট। তার উপরে এখন চলছে টুকটুক। প্রতিদিনই বাড়ছে তার সংখ্যা। এ সবের দৌরাত্ম্যে বাস চলাচলই যেন বন্ধ হতে বসেছে। প্রায়ই রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকে রিকশা, টুকটুক, সাইকেল। আবার কোথাও বা ট্রাক। যার ফলে যানজটে হাঁসফাঁস দশা রানাঘাটের। মাঝেমাঝে ছোটখাট দুর্ঘটনাও লেগে রয়েছে।
সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন পুরপ্রধান ও বিধায়ক পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “পুরনো শহর। তাই ইচ্ছা থাকলেও সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। রাস্তাগুলো সঙ্কীর্ণ। তায় রাস্তার দু’ধারে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। যার জন্য এই সমস্যা হচ্ছে।”
স্টেশন থেকে খানিকটা দূরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে রয়েছে বাসস্ট্যান্ড। রানাঘাট শহর থেকে ১৫০টির মতো বাস চলাচল করে। এর মধ্যে ৯০টি বাস ওই ব্যসস্ট্যান্ড থেকে ছাড়ে। ভবিষ্যতে ওই স্ট্যান্ড থেকে সব বাস ছাড়ার ব্যবস্থা করছে পুরসভা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যাত্রীদের দাঁড়ানোর জন্য কোনও জায়গা তৈরি হয়নি। নেই পানীয় জল বা শৌচাগারের ব্যবস্থা। একই অবস্থা স্টেশন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ডেও। এমনকী, যাত্রী প্রতীক্ষালয়টিতে বেসরকারি এটিএম কাউন্টার খোলা হয়েছে। রানাঘাট মোটর শ্রমিক (বাস) ইউনিয়নের সভাপতি শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যানজট নিয়ন্ত্রণে পুরসভা একেবারেই ব্যথর্। রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারে না। একই অবস্থা বাসের ক্ষেত্রেও। বাসস্ট্যান্ডে পরিষেবা বলতে কিছ নেই।” তবে পরিষেবার ব্যবস্থা করে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশের বাসস্ট্যান্ড থেকে সব বাস চালানো হলে সমস্যা অনেকটাই লাঘব হবে বলে দাবি তাঁর।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy