Advertisement
E-Paper

পাচারে জড়িয়ে পড়ছে পড়ুয়ারা, উদ্বেগ

মা-পিসিমার ভাঁড়ার থেকে চুরি করে বিস্কুট খাওয়ার বয়স ওদের। ওরাই ধরা পড়ছে সোনার বিস্কুট পাচার করতে গিয়ে। এই সপ্তাহের গোড়ায় নদিয়ার হাঁসখালি সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ধরা পড়ল যে কিশোর, সে ক্লাস এইটের পড়ুয়া। তারই পকেট থেকে মিলল সোনার বিস্কুট। বিস্কুটের মোট ওজন খুব বেশি না হওয়ায় ধমক-ধামক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল তাকে।

দিবাকর রায়

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪১

মা-পিসিমার ভাঁড়ার থেকে চুরি করে বিস্কুট খাওয়ার বয়স ওদের। ওরাই ধরা পড়ছে সোনার বিস্কুট পাচার করতে গিয়ে।

এই সপ্তাহের গোড়ায় নদিয়ার হাঁসখালি সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ধরা পড়ল যে কিশোর, সে ক্লাস এইটের পড়ুয়া। তারই পকেট থেকে মিলল সোনার বিস্কুট। বিস্কুটের মোট ওজন খুব বেশি না হওয়ায় ধমক-ধামক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল তাকে। কিন্তু ধরা পড়ে জুভেনাইল হোমে ঠাঁই হয়েছে, এমন পাচারকারীও কম নেই। বিএসএফ সূত্রে খবর, পাচার করতে গিয়ে যারা ধরা পড়ে তাদের কুড়ি শতাংশই নাবালক।

শিশু পাচারকারীদের গল্প বিএসএফ জওয়ানদের ঝুলিতে বড় কম নেই। একজন শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। এ বছরের গোড়ায়, শীত পড়ে এসেছে, ভোরের কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে বালির চর। সাতসকালে হাঁটু-জল পদ্মা পেরিয়ে সেই জমাট কুয়াশা ফঁুড়ে উদয় হল দু’জন ছোট ছেলেমেয়ে। মাথায় ঘাসের বোঝা। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি সীমান্তে ওই দু’জনকে দেখে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা বিএসএফ জওয়ানের হঠাত্‌ মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের ছেলেমেয়ের কথা। “কী রে তোদের পড়াশোনা নেই...”ওই জওয়ানের মুখের কথা শেষ না হতেই ঘাসের বোঝা ফেলে একছুটে চোখের আড়ালে চলে যায় ওই দু’জন। পড়ে থাকা ঘাসের বোঝা খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ! ঘাসের মধ্যে চকচক করছে চারটে সোনার বিস্কুট।

পরে ওই দু’জনকে ধরে স্থানীয় আউট পোস্টে নিয়ে যান জওয়ানরা। খবর পেয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান-সহ রাজনৈতিক দলের লোকেদের নিয়ে হাজির হন পরিবারের সদস্যেরা। তদন্তে জানা যায়, দিনে তিনশো টাকায় ওই শিশুদের দিয়ে কাজ করিয়েছে তাঁদের মা। তিনি বিএসএফকে জানিয়েছিলেন, যাঁর কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছিলেন তাঁর বাড়ি বাংলাদেশে। ঘটনার পরে পরে পুলিশ স্থানীয় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারও করেছিল।

শুধু সোনার বিস্কুটই নয়, বেশ কিছু দিন আগে বনগাঁতে স্কুলের পোশাকে এক ছাত্রীকেও আটক করেছিল পুলিশ। গরিব পরিবারের সেই ছাত্রীর ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয়েছিল ৯০ লক্ষ টাকার হেরোইন। পরে দেখা যায় মেয়েটি মূক ও বধির। বাধ্য হয়েই পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। গত বছর হেরোইন পাচারের অভিযোগে মুর্শিদাবাদের পুলিশ গ্রেফতার করেছিল দুই ছাত্রকে। তাঁরা লালগোলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা। ধৃতদের একজন পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করতেন। অন্য জন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া এলাকায় রাজ্য সড়কে তাঁদের কাছ থেকে ৫৫ লক্ষ টাকার হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছিল বলে পুলিশের দাবি। বছর কয়েক আগে নদিয়ার শিকারপুর সীমান্তেও ফেনসিডিল পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল বছর তেরোর এক কিশোর। বিএসএফের জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছিল, বাবার শরীর খারাপ। তাই মায়ের কথামতো সে ওই ‘কাজে’ বেরিয়েছিল।

সীমান্ত এলাকার এই স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের একাংশ আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের ‘ক্যারিয়ার’ হয়ে উঠছে। আর এ ভাবেই পাচার চক্রের জাল ছড়িয়ে পড়ছে সীমান্ত এলাকায়। পুলিশ সূত্রের দাবি, পুরনো ও দাগি অপরাধীদের চেয়ে শিশু ও তরুণদের পছন্দ করছে পাচার চক্রের মাথারা। দামী মোবাইল থেকে মোটরবাইকের টোপ দিয়ে কাজ হাসিল করছে তারা। এ ক্ষেত্রে যোগসূত্রের ভূমিকা নিচ্ছে স্থানীয় অপরাধীরা। তাদের দিয়েই ‘ফিট’ করানো হচ্ছে এই অভাবীদের।

কিন্তু পাচারের ক্যারিয়ার হিসাবে শিশু থেকে তরুণ ছাত্রেরা জড়িয়ে পড়ছে কেন? সীমান্ত এলাকায় পাচার থেকে বর্তমান প্রজন্মকে দূরে সরিয়ে রাখতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে প্রায় এক দশক ধরে লড়াই করে চলেছেন নদিয়ার বাসিন্দা অনির্বাণ চৌধুরী। তিনি বলছেন, “কাঁচা পয়সার লোভ সামলাতে না পেরে সোনা ও হেরোইন পাচারের ফাঁদে পা গলিয়ে দিচ্ছে শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম। একশো দিনের কাজে সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে পাওয়া যায় ১৫১ টাকা। সারাদিন বিড়ি বাঁধলে মজুরি তার চেয়েও কম। অন্য দিকে, হেরোইন পাচারের ক্যারিয়ার হলে কয়েক ঘন্টাতেই মিলে যায় বেশ কয়েক হাজার টাকা।” তাই বলে স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারাও এমন কাজ করবে? অনির্বাণ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, “পরিচিত হয়ে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা এড়াতে পাচারকারীররা নিয়মিত ক্যারিয়ার পাল্টে ফেলে। সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে পাচারচক্রের পাণ্ডারা এখন হাত বাড়িয়েছে স্কুল-কলেজের দিকে।”

অনির্বাণের বক্তব্য সমর্থন করছেন নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর এক কর্তাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “কমবয়েসিদের দিয়ে কাজ করালে পাচারকারীদের ঝুঁকি অনেক কম। ধরা পড়লে সাজাও কম হয়। ছাড়াও পেয়ে যায় তাড়াতাড়ি। অভাবী পরিবারের এই অসহায়তার সুযোগ নেয় পাচারকারীরা।” রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, “সারা রাজ্যে বছরে প্রায় হাজার খানেক পাচারের ঘটনা ঘটে। গ্রেফতারের সংখ্যাও দু’হাজারের কাছাকাছি। তবে এখন এই ধরনের অপরাধে অপরাধের রেকর্ড না থাকা কমবয়েসিদের সংখ্যা বাড়ছে। সেটাই উদ্বেগের।”

gold smugling dibakar roy students'
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy