Advertisement
E-Paper

বহু ইতিহাসের সাক্ষী রানাঘাট

এশিয়ার প্রথম রবীন্দ্র ভবন তৈরি হয়েছিল এই শহরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজি নজরুল ইসলাম-সহ বিশিষ্ট মনীষীদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে এই শহর। সঙ্গীত, নাটকের পাশাপাশি খেলাধুলাও সুনাম কুড়িয়েছে রানাঘাট। এই শহরের প্রথিতযশা মানুষদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পণ্ডিত কালীময় ঘটক, নদিয়া কাহিনীর রচিয়তা রায়বাহাদুর কুমুদনাথ মল্লিক, কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সন্তোষকুমার বোস, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ উপাচার্য ভবতোষ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

সৌমিত্র সিকদার

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৩১
রানাঘাটের সাংস্কৃতিক কর্মীদের গর্বের নজরুল মঞ্চ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

রানাঘাটের সাংস্কৃতিক কর্মীদের গর্বের নজরুল মঞ্চ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

এশিয়ার প্রথম রবীন্দ্র ভবন তৈরি হয়েছিল এই শহরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজি নজরুল ইসলাম-সহ বিশিষ্ট মনীষীদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে এই শহর। সঙ্গীত, নাটকের পাশাপাশি খেলাধুলাও সুনাম কুড়িয়েছে রানাঘাট। এই শহরের প্রথিতযশা মানুষদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পণ্ডিত কালীময় ঘটক, নদিয়া কাহিনীর রচিয়তা রায়বাহাদুর কুমুদনাথ মল্লিক, কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সন্তোষকুমার বোস, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ উপাচার্য ভবতোষ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সব মিলিয়ে এক উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে রানাঘাটের। আর সেই ঐতিহ্যকে সমানে আগলে চলেন রানাঘাটবাসী।

১৮৬৪ সালে গঠিত হয়েছিল রানাঘাট পুরসভা। তারও বছর দুয়েক আগে রানাঘাটের বুক চিরে বসেছিল রেলপথ। শহর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত খেলাধূলা সব বিষয়ে সুনাম কুড়োতে থাকে রানাঘাট। এক সময় কবি নবীনচন্দ্র সেন মহকুমাশাসক থাকাকালীন তাঁর আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ রানাঘাটে আসেন। দুই কবির মিলনে সেদিন ধন্য হয়ে গিয়েছিল এই শহর। সঙ্গীত, সাহিত্য আলোচনা নিয়ে দিন কেটে যায়। এ ছাড়াও স্বদেশী আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম। বিশ্বকবির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এলাকার মানুষ এই শহরের বোসপাড়ায় গড়ে তুলেছিলেন এশিয়ার প্রথম রবীন্দ্রভবন। তবে ২০০০ সালের বন্যায় ব্যবহারের অনুপযুক্ত হওয়ায় ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। রানাঘাটের মানুষ পুনরায় তা তৈরি করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। রানাঘাটের তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক শুভময় মিত্র বলেন, “এক সময় পুকুর ভরাট করে ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল। যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। খুব শীঘ্রই তৈরির কাজ শুরু করা হবে।”

ব্রিটিশদের সময় রানাঘাটে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে শুরু করে। কবি গিরিজানাথ মুখোপাধ্যায় হাত ধরে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘বার্তাবহ’। রানাঘাট রেল স্টেশন কাছে গিরিজানাথের পত্রিকা অফিসে বসত সাহিত্য আড্ডা। পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক কোশলদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এক সময় আমাদের পত্রিকা অফিসে এসেছিলেন কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রিটিশ বিরোধী লেখার জন্য আমার বাবা প্রয়াত রমণীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কলকাতায় লুকিয়ে কাটাতে হয়েছিল।” নানা সময়ে এই শহর থেকে পল্লিচিত্র, অশনি, ছাত্রবাণী, ফ্ল্যাশ, খেলাধূলা, শ্রমিক ও সমাজ, টর্চ, সীমান্তবাণী, বাংলা বাজার, ঝড়, ফ্লিক, চ্যালেঞ্জ, সবুজসোনা, চুর্ণী, নদিয়া গৌরব, রাতু-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ পেয়েছিল।

বিষ্ণুপুরের মতো সঙ্গীতের নিজস্ব ঘরানা রয়েছে রানাঘাটের। এই ঘরানার প্রথম পুরুষ নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বাবা উমানাথ ভট্টাচার্যের কাছে তালিম নেন। পরে তিনি আহমদ খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে বন্নে খাঁ, বড়ে দুন্নি খাঁ, রমজান খাঁ, শ্রীজান বাঈ, মহেশচন্দ্র মখোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নিয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এ ছাড়াও, সঙ্গীত শিক্ষক যদু ভট্টের কাছ থেকেও তিনি ধ্রুপদের শিক্ষা গ্রহণ করেন। সব কিছুর মাঝে নিজের প্রতিভা বলে সঙ্গীতে নিজস্ব শৈলী গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে এই শৈলী নিয়ে চর্চা করেছেন তাঁর শিষ্যেরা। আজও সেই ঘরানার খোঁজ পাওয়া যায়। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে নির্মল চট্টোপাধ্যায়, প্রমথনাথ ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সৌরেশ বন্দোপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ দত্তের নাম উল্লেখযোগ্য। অনেকের মতে, রানাঘাট ঘরানার সম্ভবত সব থেকে খ্যাতিমান শিল্পী শিবকুমার চট্টোপাধ্যায় যিনি সকলের কাছে ‘গুলিনদা’ নামে পরিচিত। এ ছাড়াও সরোজ দত্ত, অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়, পূরবী দত্ত-সহ বেশ কয়েক জন সঙ্গীত শিল্পী শহরকে সমৃদ্ধ করেছেন। নৃত্য প্রশিক্ষণে জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন।

সঙ্গীতের পাশাপাশি নাটকেও বিশেষ নাম রয়েছে এই শহরের। পালচৈাধুরীদের হাত ধরেই এই অগ্রগতি ঘটেছে বললে ভুল হবে না। ব্রজনাথ পালচৌধুরী ও দ্বারিকানাথ পালচৌধুরী উদোগ্যে বাসন্তী ক্লাব নামে প্রথম থিয়েটারের দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর পরে হ্যাপি ক্লাব, মেরি ক্লাব, ন্যাশনাল ক্লাব, মডেল মিউজিক অপেরা, ডিফেন্স ড্রামাটিক ক্লাব, ইয়ং মেন্স অ্যাসোসিয়েশন, তরুণ সঙ্ঘ, যুব সঙ্ঘ, এমিকেবল ক্লাব, মিলন সঙ্ঘ, সুহৃদ সঙ্ঘ, শিল্পীদল, রূপকার, বৈকালী, পরপারের যাত্রী, রূপারূপ নাট্য সংস্থা, নাট্যমঞ্চ-সহ বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠন শহরের নাট্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বিশিষ্ট নাট্যকার ও পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্ত, কৌতুক শিল্পী হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি হরবোলা হরিদাস নামে সকলের কাছে পরিচিত। সেই সময় মঞ্চে বেশ কিছু পুরুষ শিল্পী মহিলাদের ভুমিকায় অভিনয় করতেন। রূপারূপ নাট্য সংস্থার পরিচালক গোপাল মুখোপাধ্যায় বলেন, “জিনিসের দাম ও ভাড়া বেড়ে গিয়েছে। তারপর, উৎসাহী মানুষের অভাব রয়েছে।” তিনি বলেন, “সব কিছুর মধ্যে থেকেও আমরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আনন্দ দেওয়ার জন্য হাস্যরসের নাটক বেশি পরিবেশন করে থাকি। এতে ভাল সাড়া পাওয়া যায়।”

শুধু শিল্প সংস্কৃতি নয় খেলাধূলার জগতেও রানাঘাট পরিচিত নাম। রানাঘাটের প্রবীণ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ও ক্রিকেট খেলোয়ার প্রণব মুখোপাধ্যায় জানালেন, খেলাধূলার ক্ষেত্রেও এই শহরের নাম বিশেষ ভেবে উল্লেখযোগ্য। রানাঘাটের ফুটবল খেলার পথিকৃৎ বলা যায়। টাউন ক্লাব পরে বিশ্বাস পাড়া, পাইওনিয়ার, তরুণ ব্যায়াম সমিতি, স্বাস্থ্যোন্নতি সমিতি, নির্মল স্বাস্থ্যোন্নতি সমিতি, বোসপাড়া ভারতী সঙ্ঘ, অ্যাথলেটিক ক্লাব-সহ বিভিন্ন ক্লাব ও বিদ্যালয় এগিয়ে আসে। এখানকার কয়েকজন খেলোয়াড় বিদেশেও খেলতে গিয়েছেন। অজিত নন্দী ইস্টবেঙ্গলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া সফর করেছেন। অনিল নন্দী ১৯৪৮ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অলিম্পিকে ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। নিখিল নন্দী ১৯৫৬ সালে মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে ভারতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ছাড়াও, এখানকার বহু খেলোয়াড় কলকাতার মাঠে খেলেছেন। অবনী বসু, সুধীর রায়, বিশ্বনাথ পাল, কৃষ্ণ মিত্র, কৃষ্ণ মণ্ডল, অসীম কুণ্ডু, গোবিন্দ গুহঠাকুরতা, বিদ্যুৎ মিত্র-সহ আরও অনেকে কলকাতার মাঠে খেলেছেন। এখানকার বেশ কয়েক জনকে পরবর্তীতে ভাল রেফারির ভুমিকায় দেখা গিয়েছিল। ফুটবল ছাড়াও, ক্রিকেট, ভলিবল, সাঁতার, অ্যাথলেটিক্স, জিমন্যাস্টিক, টেনিস, খোখো খেলাতেও বিশের নজির রেখেছিল। পুরানো দিন ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে পুরসভা। পুরপ্রধান পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা স্পোর্টস একাডেমি চালু করেছি। সেখানে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল ও কবাডি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।”

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসেও জড়িয়ে রয়েছে রানাঘাটের নাম। নীলবিদ্রোহ, স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন মানুষ। অসহযোগ আন্দোলনে শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র মিত্র, নেপালচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, রেণুমাধব দাস, শিশিরকুমার বসু, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনে সহায়রাম দাস, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অসীমকুমার মজুমদার, বিমলকুমার চট্টোপাধ্যায়, নৃসিংহ চৌধুরী, কুমারেশ বিশ্বাস, মহম্মদ হবিবুল্লহ, মহম্মদ কালু শেখ, শ্রীধর মুখোপাধ্যায়, পটল মুস্তাফি-সহ অনেকেই রয়েছেন সেই তালিকায়। তবে দিন বদলের সঙ্গে রানাঘাটের নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন প্রবীণ বাসিন্দারা। তাঁদের মতে, ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদই নেই নতুন প্রজন্মের! (শেষ)

amar sohor soumitra sikder ranaghat
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy