জলঙ্গি নদীর পাড় থেকে এই ভাবেই কেটে নেওয়া হয় মাটি। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
পতাকার সব রঙ এখানে মিলেমিশে একাকার। শুরু হয়েছে এক অন্য লড়াই। মাটি দখলের লড়াই।
পুলিশ-প্রশাসনের প্রশ্রয়-পুষ্ট সর্বদলীয় মাটি-মাফিয়া বাহিনীর সৌজন্যে গত কয়েক বছর ধরে ভাগীরথী, পদ্মা-সহ মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার নদীগুলির পাড় থেকে দৈনিক কয়েকশো লরি মাটি কেটে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অবৈজ্ঞানিক উপায়ে অবৈধ ভাবে মাটি কাটার ফলে বাড়ছে ভাঙনের প্রবণতা। বদলে যাচ্ছে নদীর গতিপথ।
নদী ভাঙনের জেরে মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ান পুরসভা ও শমসেরগঞ্জ ব্লক কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের রিপোর্টে ‘রেড অ্যালার্ট এরিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত। অথচ ধুলিয়ান পুরসভার শ্মশানঘাট থেকে শমশেরগঞ্জের প্রতাপগঞ্জ এলাকা পর্যন্ত মাটি কাটার উৎসব চলেছে। পাঁচ থেকে ১৫ ফুট গভীর গর্ত করে সেই মাটি কাটার ভাগ পায় সকলেই। ওই এলাকায় পরিচিত ১৫ থেকে ২০ জনের মালিকানাধীন প্রায় ৭০টি ইটভাটা চলেছে রমরমিয়ে। গত ২০ বছর ধরে ওই কর্মকাণ্ডে শরিক সকলেই। কোনও প্রতিবাদ নেই। আন্দোলন দূরের কথা। সরকরি হিসেবে প্রতি দিন ওই এলাকা থেকে প্রায় দেড়শো ট্রাক্টর মাটি তোলা হচ্ছে। জলসম্পদ মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী যার পরিমাণ প্রায় কুড়ি হাজার ঘন মিটার। ধুলিয়ানের মতোই অবস্থা নদিয়ার ধুবুলিয়ার বাহাদুরপুরের জলঙ্গি নদীর। সেখানেও মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে অবাধে। স্থানীয় বাসিন্দারা মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করেন। কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকে মাটি তোলার কাজ। তারপরে ফের একই ঘটনা। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলায় মাটি মাফিয়াদের দাপট কতটা, তা বেআইনি ইটভাটার পরিসংখ্যান দেখলেই পাওয়া যাবে। কারণ এই ভাবে যে মাটি তোলা হয়, তার সিংহভাগই যায় ইটভাটায়। নদিয়ায় প্রায় ৩০০টি এবং মুর্শিদাবাদে ৫০০টি বেআইনি ইটভাটা চলে। কৃষ্ণনগর থেকে করিমপুর অথবা করিমপুর থেকে বহরমপুর রাজ্য সড়কের দু’পাশের চাষের জমিতেও রমরমিয়ে চলছে অজস্র বেআইনি ইটভাটা।
কলকাতা থেকে ফোন করায় চমকে গিয়েছিলেন ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের তরুণ ইঞ্জিনিয়ার। মাটি মাফিয়াদের ভয়। তাই নাম লিখতে বারবার বারণ করছেন। তিনি বললেন, “সাড়ে তিন দশক আগে প্রাকৃতিক বিপর্যয় রুখতে যে বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল, মাটি মাফিয়াদের লোভে তা আজ বিপন্ন। যদি হিসেব করেন তাহলে দেখতে পাবেন লালগোলার ময়া থেকে রঘুনাথগঞ্জের রামপুর পর্যন্ত ন’কিলোমিটার এলাকায় প্রতিদিন চারশো লরি মাটি কাটা হচ্ছে। বাকিটা বুঝে নিন। আমাদের আর কী করার আছে।’’ পদ্মার চরে বাচ্চাদের পড়ায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেই সংস্থার এক কর্তার কথায়, “ওই এলাকায় যে ভাবে মাটি কাটা চলেছে তাতে বড় বিপর্যয় আসতে খুব দেরি নেই।”
এই ভয়টাই সবচেয়ে বেশি পরিবেশবিদদের। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “নদীর পাড় থেকে যে ভাবে মাটি কাটা হচ্ছে তাতে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বদলে যেতে পারে নদীর গতিপথ। যে কোনও নদীতে যে কোনও সময়ে ভাঙন দেখা দিতে পারে। নদীর লাগোয়া জমি হারিয়ে যাবে। বন্যার সম্ভবনা বাড়বে।”
শুধু নদীর মাটি লুঠ করেই বসে থাকছে না মাফিয়ারা। তাদের নজরে রয়েছে চাষের জমি, আমবাগান, ছোট জলাশয়--সব কিছুই। গ্রামের বাস্তুতন্ত্রটাই বদলে যাচ্ছে
মাটি-মাফিয়াদের দাপটে। অবৈজ্ঞানিক উপায়ে যেখানে-সেখানে মাটি কেটে নেওয়ার পর যখন তা জলাশয়ে পরিণত হচ্ছে, কোথায়-কত গভীরতা বোঝা যাচ্ছে না। গত এপ্রিল মাসে নির্বাচনের সময়ে রঘুনাথগঞ্জের কাঁটাখালি গ্রামে ভাগীরথী লাগোয়া এলাকায় মাটি কাটা জলাশয়ে তলিয়ে গিয়ে মারা যায় তিন জন কিশোর-কিশোরী। বছর খানেক আগে শমশেরগঞ্জেও এক জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়াও মাটি তোলার সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যু তো রয়েছেই।
অবৈধ মাটি তোলাই হোক বা ইটভাটাচোখে হাত চাপা দিয়ে থাকে পুলিশ। উল্টে প্রশাসন-পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করেই মাটি কাটার এই কারবার চলে বলে অভিযোগ। তা ছাড়া শাসক ও বিরোধী দলের নেতাদের একাংশ মাটি মাফিয়া ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মাস্কেট বাহিনীকে নিয়মিত মদত দেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা পান তাঁরাও। এক সময়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাঙন ও বন্যা প্রতিরোধের জন্য নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছিল বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস। কিন্তু সেই রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও মাটি-মাফিয়া বাহিনীর কর্তাদের দেখা গিয়েছে। এমনই লম্বা হাত মাটি-মাফিয়াদের।
যদিও পুলিশ এই অভিযোগ মানতে নারাজ। মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, সমস্যাটা আইনে ফাঁকের। তিনি বলেন, “মাটি মাফিয়ারাও কিন্তু প্রশাসন থেকে একটা অনুমতি নিয়ে রাখে। সেটা হয়তো একশো লরির। বাস্তবে মাটি কাটল হাজার লরির। এখন এটা ধরবে কে? নির্বাচনের আগে ক্রাইম কনফারেন্সে মাটি-মাফিয়াদের বাড়াবাড়ি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় স্তর থেকে নির্দিষ্ট অভিযোগ না এলে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।”
রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস, “খুব শীঘ্রই মাটি কাটা সংক্রান্ত একটি অর্ডিন্যান্স জারি হবে। তা কার্যকর হলে অনেকটাই কড়া পদক্ষেপ করা যাবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy