Advertisement
E-Paper

শেষ দেখলাম, ঘোড়ায় ওঠার চেষ্টা করছে অরূপ

চোখ বুজলেই তুষারঝড়ের সাঁই সাঁই শব্দটা কানে আসছে। নিজের বাড়ির বিছানায় শুয়েও বরফে ডুবে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন বারবার তাড়া করছে বছর চল্লিশের সুব্রত দত্তকে। ৩৪ বছরের সুমিত মুখোপাধ্যায়ের গলার স্বরেও এখনও আতঙ্কের ছাপ। বললেন, “আমার এত ভারী শরীরটাও হাওয়ার দাপটে এ-দিক ও-দিক হয়ে যাচ্ছিল। আর সেই প্রবল হাওয়ায় মিশে থাকা বরফের গুঁড়োয় এক হাত দূরের জিনিসও দেখতে পাচ্ছিলাম না। সামনের লোকের পায়ের ছাপ বরফে চাপা পড়ে হারিয়ে যাচ্ছিল নিমেষে...।”

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৫৭

চোখ বুজলেই তুষারঝড়ের সাঁই সাঁই শব্দটা কানে আসছে। নিজের বাড়ির বিছানায় শুয়েও বরফে ডুবে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন বারবার তাড়া করছে বছর চল্লিশের সুব্রত দত্তকে। ৩৪ বছরের সুমিত মুখোপাধ্যায়ের গলার স্বরেও এখনও আতঙ্কের ছাপ। বললেন, “আমার এত ভারী শরীরটাও হাওয়ার দাপটে এ-দিক ও-দিক হয়ে যাচ্ছিল। আর সেই প্রবল হাওয়ায় মিশে থাকা বরফের গুঁড়োয় এক হাত দূরের জিনিসও দেখতে পাচ্ছিলাম না। সামনের লোকের পায়ের ছাপ বরফে চাপা পড়ে হারিয়ে যাচ্ছিল নিমেষে...।”

নেপালের থোরাং পাস পেরিয়ে মুক্তিনাথের পথে ট্রেকিং করতে গিয়ে যে এ ভাবে মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে ফিরতে হবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি দমদমের বাসিন্দা সুমিত, সুব্রত দত্ত। দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন দমদমেরই অরূপ রায়চৌধুরী ও রিষড়ার সুব্রত দাস। আর ছিলেন নেপালের স্থানীয় গাইড অজয়।

তিন বন্ধু বেঁচে ফিরলেও অরূপ রায়চৌধুরীকে ফিরতে হয়েছে কালো কফিনে বন্দি হয়ে। সুমিত জানালেন, সাত তারিখে ট্রেকিং শুরু করার সময়ে ঝকঝকে ছিল আবহাওয়া। ১৩ তারিখ বিকেল থেকে মেঘ জমেছিল আকাশে। সেই সঙ্গে হাল্কা তুষারপাত। সে দিন বেসক্যাম্পে ছিলেন তাঁরা। পাহাড়ের ওই উচ্চতায় ও রকম আবহাওয়া খুবই স্বাভাবিক, তাই কোনও বিপদের আশঙ্কা না করেই ১৪ তারিখ সতেরো হাজার ফুট উঁচু থোরাং পাসের উদ্দেশে ট্রেকিং শুরু করেছিলেন তাঁরা। পাস পেরিয়ে মুক্তিনাথ পৌঁছনোর কথা। মুক্তিনাথের উচ্চতা তেরো হাজার ফুট।

সুমিত বললেন, “পাস পর্যন্ত ওঠার ৫০০-৬০০ মিটার আগে আচমকাই খারাপ হয়ে যায় আবহাওয়া। চার পাশ থেকে হাওয়া চলতে শুরু করে। হাওয়ার দাপটে রীতিমতো ওলটপালোট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন অনেকে।” সুমিত জানালেন, দলের দুই সদস্য সুব্রত দত্ত ও অরূপ রায়চৌধুরী তখনই বলেন, হেঁটে নামতে অসুবিধা হচ্ছে। তাঁরা ঘোড়ায় চড়ে নামবেন। দু’জনের জন্য দু’টো ঘোড়া ঠিক করাও হয়। কিন্তু তখন হাওয়ার দাপটে একটু দাঁড়িয়ে কথা বলাও মুশকিল হচ্ছিল। “ওরা ঘোড়ার ব্যবস্থা করার পরেই আমি আর সুব্রত দাস পাসের দিকে উঠতে শুরু করি। তাড়াতাড়ি মুক্তিনাথ পৌঁছনোই তখন লক্ষ্য ছিল আমাদের।” বললেন সুমিত। পিছনে ঘোড়ার সঙ্গে দরদাম করছিলেন অরূপ আর সুব্রত দত্ত।

আর ঠিক এখান থেকেই বদলে গিয়েছিল অরূপ ও সুব্রত দত্তর গল্পটা। মঙ্গলবার নিজের বাড়িতে বসে সুব্রত বললেন, “অরূপ আর হাঁটতে পারছিল না। ঘোড়া দেখে আমরা যেন হাতে চাঁদ পেলাম। ঘোড়ার সহিসের সঙ্গে দরদাম করে দু’টো ঘোড়া নিলাম। চুক্তি হল ঘোড়া দু’টোই আমাদের মুক্তিনাথ পৌঁছে দেবে। সুমিত আর সুব্রত দাস হাঁটতে শুরু করে তখনই।”

কিন্তু প্রকৃতি যেন ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। সুব্রত বললেন, “এত জোরে হাওয়া দিচ্ছিল, ঘোড়ায় উঠতেই পারছিলাম না ঠিক করে। সহিসও ঘোড়াটাকে সামলাতে পারছিলেন না। আমি কোনও রকমে উঠলাম। পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অরূপ ঘোড়ায় ওঠার চেষ্টা করছে। তখনই অরূপকে শেষ বারের মতো দেখলাম।”

শেষ পর্যন্ত অরূপবাবু কি ঘোড়ায় উঠতে পেরেছিলেন? জানেন না সুব্রত। তুষাঝড়ে এক হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ঘোড়াটা তাঁকে নিয়ে কোন দিকে যাচ্ছিল তা-ও বুঝতে পারছিলেন না। একাধিক বার খাদে পড়তে পড়তে বেঁচে যান তিনি। ঘোড়াটা কোনও রকমে থোরাং পাস পৌঁছে আর যেতে পারেনি। তাঁকে নামিয়ে দেন সহিস।

থোরাং পাসে তখন প্রবল ঝড়। চার দিক সাদা হয়ে গিয়েছে। অন্য দুই বন্ধুর খোঁজ করতে গিয়ে তখনই হাওয়ার দাপটে রাস্তার পাশে একটা খাদে পড়ে যান সুব্রত। খাদের মধ্যে বরফে ঢুকে যেতে শুরু করে তাঁর শরীরটা। সুব্রতবাবু বলেন, “তখন আমার কোমর পর্যন্ত বরফের নীচে। মনে হচ্ছিল, আর মিনিট খানেকের মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। হাত পা অবশ হয়ে আসছিল আমার।”

কিন্তু সুব্রতবাবুর জন্য ভাগ্য অন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আচমকাই তিনি দেখতে পান এক দল ফরাসি পর্যটক খাদের উপরের রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছেন বাঁচার জন্য। সুব্রত “হেল্প হেল্প” করে চিৎকার করতে থাকেন। চিৎকার শুনে ওই ফরাসি পর্যটকরাই খাদ থেকে টেনে তোলেন সুব্রতকে।

সুমিত জানালেন, নামার সময়ে একটানা তুষারপাতে প্রায় কয়েক ফুট উঁচু বরফে ঢেকে গিয়েছিল রাস্তাটা। প্রাণের ভয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে দিয়ে দৌড়তে থাকেন সুমিতরা। আরও কয়েকশো বিদেশি পর্যটকের তখন একই অবস্থা। দিশা পাচ্ছিলেন না নেপালের অভিজ্ঞ গাইড-শেরপারাও। বললেন, “বিকেলে যখন মুক্তিনাথ পৌঁছলাম, মনে হচ্ছিল নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। আর নিরাপদ আশ্রয় পেয়েই প্রথম মনে পড়ল অরূপদের কথা। ওদের তো পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল।” ভাবতে ভাবতেই কিছু ক্ষণের মধ্যে এক দল ফরাসি পর্যটকের সঙ্গে মুক্তিনাথে এসে পৌঁছন সুব্রত দাস। ভেজা, বিধ্বস্ত। তাঁকে গরম জামা, চা খাইয়ে সুস্থ করেন সুমিতরা। কিন্তু অরূপের কোনও খোঁজ মেলে না রাত পর্যন্ত। মেলে না পরের দিন, ১৫ তারিখেও। কিন্তু সে দিন আর চিহ্ন ছিল না আগের দিনের তাণ্ডবের। ঝকঝক করছে আকাশ। শুধু কাছের মানুষকে খুঁজে না পাওয়ার আর্তি চার পাশে। সে দিনই পুরোদমে উদ্ধারকাজ শুরু করে দেয় নেপালের সেনাবাহিনী। ঘটনাস্থলে পৌঁছয় একাধিক হেলিকপ্টার। স্থানীয় বাসিন্দারাও যথাসম্ভব সাহায্য করছিলেন। বরফে আটকে পড়া বহু পর্যটককে মুক্তিনাথে নামিয়ে আনা হয়। আনা হয় অনেক মৃতদেহও। তার পরের দিন সুমিতদের দলের পোর্টার অজয়ের দেহ এসে পৌঁছয় মুক্তিনাথে। সুব্রত দত্ত বললেন, “বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। মনে হল পোর্টারই যখন বেঁচে ফিরল না তখন অরূপ কি পারবে?”

সুব্রতবাবুর আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। অরূপের মৃতদেহ উদ্ধার হয় শুক্রবার। সোমবার রাতে বন্ধুর কফিনবন্দি দেহ নিয়ে কাঠমান্ডু থেকে ফিরেছেন সুব্রত দত্ত, সুব্রত দাস, সুমিত মুখোপাধ্যায়। সুব্রত দত্ত বললেন, “এর আগে যে সব ট্রেকিং করেছি, তার তুলনায় এই পথ ছিল জলভাত। এই পথ দিয়ে ৬৫-৭০ বছরের বৃদ্ধরাও যেতে পারেন। অরূপের তেমন প্রশিক্ষণ না থাকলেও ওর কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না।”

সুব্রত জানালেন, সে দিনের প্রথম দু’ঘণ্টা সব ঠিকঠাক ছিল। থোরাং পাস পৌঁছতে তখন বড় জোর আধ ঘণ্টার পথ বাকি ছিল। হঠাৎই হাওয়ার গতি মারাত্মক বেড়ে গেল। বেড়ে গেল তুষারপাতও। কয়েক মিনিটের মধ্যে যেন পুরো পরিবেশটাই পাল্টে গেল। “আর তাতেই হারিয়ে গেল অরূপ। চিরকালের মতো।” আক্ষেপ ঝরে পড়ল সুব্রতর গলায়। বললেন, “আমি তো স্ত্রী আর তিন বছরের মেয়ের কাছে ফিরতে পারলাম। অরূপ পারল না। ওর মেয়েটা যখন বড় হবে তখন ওকে কী বলব!”

পৌঁছল আরও দুই বাঙালির দেহ

তুষার ঝড়ে মৃত ডোমজুড়ের সুনীল সেন ও শেওড়াফুলির ইন্দ্রনীল ঘোষের দেহ কলকাতা এসে পৌঁছল মঙ্গলবার সন্ধেয়। সুনীল সেনকে বিমানবন্দর থেকেই শিবপুর শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান তাঁর দিদি চৈতি সেন। সন্ধে থেকেই প্রতিবেশীদের ভিড় উপচে পড়ে ইন্দ্রনীলের বাড়ির সামনে। কিন্তু এখনও সন্ধান মেলেনি আর এক নিখোঁজ বাঙালি পর্যটক তথাগত জানার। নেপাল প্রশাসন জানিয়েছে, মঙ্গলবার আরও এক বাঙালির দেহ উদ্ধার হয়েছে। পরিচয়পত্র দেখে জানা গিয়েছে, নাম দেবাশিস দে। কিন্তু রাজ্য সরকার সূত্রে জানানো হয়েছে, ওই নামের কোনও পর্যটকের রেকর্ড নেই তাঁদের কাছে।

nepal avalanche sunil sen indranil ghosh tathagata jana latest news online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy