Advertisement
E-Paper

পুলিশ খবর দেওয়ার আগেই মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে গেল গ্রামে

বাঁশের উপরে মাটি লেপা বাড়ি। উপরে টালির চাল, সামনে তুলসীমঞ্চ। ভিতর থেকে মেয়েলি গলায় গুমরে ওঠা কান্নার আওয়াজ চুঁইয়ে আসছিল বাইরে। কে কাঁদে? কেউ না! তড়িঘড়ি জবাব দেন বাড়ির পুরুষেরা। পুরুষ বলতে বাড়ির কর্তা প্রৌঢ় গোপাল মণ্ডল, তাঁর বড় ছেলে গৌরহরি আর ছোট ছেলে পলাশ। আর মেজো জন?

কৌশিক মিশ্র

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৪৯
সুবহানের ছবি হাতে জ্যোৎস্নাবালা মণ্ডল।—নিজস্ব চিত্র।

সুবহানের ছবি হাতে জ্যোৎস্নাবালা মণ্ডল।—নিজস্ব চিত্র।

বাঁশের উপরে মাটি লেপা বাড়ি। উপরে টালির চাল, সামনে তুলসীমঞ্চ।

ভিতর থেকে মেয়েলি গলায় গুমরে ওঠা কান্নার আওয়াজ চুঁইয়ে আসছিল বাইরে। কে কাঁদে?

কেউ না!

তড়িঘড়ি জবাব দেন বাড়ির পুরুষেরা।

পুরুষ বলতে বাড়ির কর্তা প্রৌঢ় গোপাল মণ্ডল, তাঁর বড় ছেলে গৌরহরি আর ছোট ছেলে পলাশ। আর মেজো জন?

সে তো অনেক দিনই বাড়ি নেই। কলকাতায় কাজে গিয়েছে।

কী নাম তার? স্বপন না সুবহান?

“না না, ও সব নয়, আমার মেজো ছেলের নাম গৌতম” বলে ওঠেন গোপালবাবু। অথচ গত বৃহস্পতিবার খাগড়াগড় বিস্ফোরণে মৃত বছর চব্বিশের সুবহান ওরফে স্বপন মণ্ডলের খোঁজ করতে-করতেই পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরে এই উত্তরবাড় গ্রামে পৌঁছেছে পুলিশ। বুধবারও তারা গ্রামে গিয়েছিল। কিন্তু ধোঁয়াশা কাটেনি।

সোমবার সন্ধ্যাতেই গোপালবাবুর এক ভাইপোর মোবাইলে মৃতের ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিল বর্ধমান পুলিশ। রাতে ছবি নিয়ে ভগবানপুর থানার পুলিশও তাঁদের বাড়িতে যায়। বাড়ির লোকজন পুলিশকে জানিয়ে দেন, এ ছবি তাঁদের ছেলের নয়। গৌতমের সঙ্গে সে ছবির কোনও মিল নেই।

ছেলে কবে থেকে বাড়িছাড়া?

গৌরহরি জানান, তাঁর ভাইয়ের বয়স এখন বছর চব্বিশ। বছর বারো আগে একাদশী মণ্ডল নামে স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে কাজের খোঁজে কলকাতায় গিয়েছিল গৌতম। দীর্ঘদিন বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। পরে জানা যায়, একাদশীর সঙ্গেই আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটি চাউমিনের দোকানে সে কাজ করছে। পরে সেই যোগাযোগই ছিন্ন হয়ে যায়। ২০০৮-এ বন্যার সময়ে এক বার বাড়ি ফিরেছিল। দিন দুয়েক ছিল। “ছেলে তখন বলেছিল, শ্যামবাজারে একটা ক্যাটারিংয়ের দোকানে কাজ করছে। সেই যে গেল, অনেক দিন দেখা ছিল না” বলেন গোপালবাবুর স্ত্রী জ্যোৎস্নাবালা।

কবে শেষ দেখেছেন গৌতমকে?

“মাস ছয়েক আগে। কলকাতা থেকে ও পাঁশকুড়া পর্যন্ত এসেছিল, সেখান থেকে আমি ওকে নিয়ে আসি” বলেন গৌরহরি। ক্ষয়াটে চেহারা, একমাথা উসকো-খুসকো চুল, নোংরা জামাকাপড় পরা ছেলেটিকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারেননি বাড়ির লোকেরা। গৌরহরি বলেন, “ট্রেনে ও একটাও কথা বলেনি। খালি বলেছিল, বাড়ি আসতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমার যেন কী হয়ে গিয়েছে। সব কিছু ভুলে যাই।” গৌরহরির স্ত্রী তনুশ্রী জানান, কলকাতায় ফেরার আগে তাঁকে একটা মোবাইল নম্বর দিয়ে গিয়েছিল মেজো দেওর। কয়েক মাসের মধ্যে বিয়ের পরিকল্পনার কথাও বলে। তনুশ্রী বলেন, “বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথা বলেছিলাম। বলেছিল, এর পর থেকে নিশ্চয়ই পাঠাবে।”

সেই মোবাইল নম্বরে অবশ্য মাসখানেকের বেশি ধরা যায়নি ছেলেটিকে। তার পর থেকে যখনই ফোন করা হয়েছে, মোবাইল ‘সুইচড অফ’। এ দিনও সেই নম্বরে বারবার ফোন করে দেখা গিয়েছে, মোবাইল বন্ধ। গোপালবাবু বলেন, “যার ছবি আমাদের দেখানো হয়েছে, সে আমার ছেলে নয়। তবু বারবার পুলিশ এসে জেরা করছে। ছেলেকে খোঁজার জন্য আমরা কলকাতায় পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। খোঁজ না মেলায় সমস্যা আরও বাড়ছে।”

পুলিশও কয়েকটা অঙ্ক পুরোপুরি মেলাতে পারছে না।

প্রথমত, বিস্ফোরক তৈরির মূল পান্ডা স্বপন ওরফে সুবহান মৃত্যুর আগে জড়ানো গলায় যা বলেছিল, তাতে পুলিশের মনে হয়েছিল, তার বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের উত্তরপাড়ায়। জেলা পুলিশ ওই নামে কোনও গ্রামের হদিস দিতে পারেনি। তাই ধরে নেওয়া হয়, সুবহান আসলে ‘উত্তরবাড়’ কথাটি বলতে চেয়েছিল। এই পরিবারটির এক ছেলে নিখোঁজ থাকায় পুলিশ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সূত্রে পুলিশ জেনেছে, ছেলেটি শেষ যে বার বাড়ি আসে, তার সঙ্গে এক মহিলা ছিলেন। সে এক বাংলাদেশি মহিলাকে বিয়ে করেছিল বলেও একটি সূত্রে পুলিশের কাছে খবর এসেছে। যদিও পরিবারের তরফে তা অস্বীকার করা হয়েছে। তৃতীয়ত, পুলিশ জানানোর দু’দিন আগে, গত শনিবারই পরিবারের কাছে খবর গেল কেমন করে, তা-ও পরিষ্কার হয়নি।

“শনিবার গ্রামের কিছু লোক বলাবলি করছিল যে আমাদের বাড়ির ছেলে মারা গিয়েছে। সেই কথা আমাদেরও কানে আসে” জানান গোপালবাবু। কারা তাঁকে ছেলের মৃত্যুর কথা বলেছিল? গোপালবাবু কারও নাম বলতে চাননি। ঠিক এই সময়েই এসে হাজির হন তৃণমূলের স্থানীয় অঞ্চল সভাপতি নান্টু প্রধান। গোপালবাবুকে একপ্রকার থামিয়ে দিয়ে তিনি বলতে থাকেন, “না না, উনি ভুল বলছেন। শনিবার ওঁরা কিছু শোনেননি। যা শোনার, সোমবার পুলিশের কাছেই শুনেছেন।”

গ্রামের লোকজনও বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ‘আমরা কিছু জানি না’ বলে তাঁরা ভিতরে ঢুকে যান। কয়েক জন পড়শি আবার মোবাইলে ছবি না দেখেই বলে দেন, ‘একে আমরা চিনি না’। ছোটবেলায় প্রতিবেশী বিষ্ণুপদ মণ্ডলের কাছে পড়ত গৌতম। তিনি বলেন, “ও বরাবরই শান্ত প্রকৃতির ছিল। তেমন বন্ধুও ছিল না ওর।” পুলিশ যে মৃতদেহের ছবি দেখাচ্ছে, সেটা কি গৌতমেরই?

একটু থেমে বিষ্ণুবাবু বলেন, “এ নয় মনে হচ্ছে।”

পুুলিশ কী ভাবছে? জেলার পুলিশ সুপার সুকেশকুমার জৈন শুধু বলেন, “নতুন তথ্য নেই। খোঁজ চলছে।”

khagragarh blast case burdwan subhan mondal gopal mondal burdwan blast state news online state news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy