দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী ব্লকের ভরগতগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের সাত নম্বর গরানবোসে থাকেন এই মহিলা। গ্রামে তো দূর অস্ত, গোটা ভরতগড় পঞ্চায়েতে কোনও ব্যাঙ্ক নেই। নিকটবর্তী ব্যাঙ্ক বাসন্তী সদরে। মাতলার ধারে এক নম্বর গরানবোস, চার নম্বর গরানবোসের মতো প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বাসন্তীর সেই ব্যাঙ্কের দূরত্ব কমপক্ষে ১২ কিলোমিটার। সঙ্কীর্ণ এবং নিদারুণ ভাঙাচোরা পথে কোনও জনপরিবহণ ব্যবস্থা নেই। পায়ে হেঁটে বা বাই-সাইকেলে ভরতগড় বাজার পৌঁছতে হয়। সেখান থেকে ভ্যান-রিক্সায় পৌঁছতে হয় শিবগঞ্জের ‘বড় রাস্তা’য়। সেখানে সুন্দরবন আদর্শ বিদ্যানিকেতনের মোড় থেকে বাস বা অটোয় বাসন্তী যেতে হয়। খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছলেও গরানবোস, ভরতগড় থেকে বাসন্তীর ব্যাঙ্কটিতে পৌঁছতে এক ঘণ্টা লেগেই যায়। কিন্তু ভরতগড় এবং বাসন্তী পঞ্চায়েত এবং আশপাশের এলাকা মিলিয়ে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক গ্রামের একমাত্র ভরসা ওই সবেধন নীলমণি এসবিআই শাখা। ফলে রোজ সকালে ব্যাঙ্ক খোলার ঘণ্টা তিনেক আগে থেকেই বন্ধ দরজার সামনে লাইন লম্বা হয়ে যাচ্ছে। সন্ধে নামা পর্যন্ত সেই লাইনের বহর বাড়ছে বই কমছে না। যাঁরা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের কাজ যে এক দিনেই মিটছে, তেমনও নয়। এক রাজ্য সরকারি কর্মী পরিহাসের সুরে বললেন, ‘‘সুন্দরবন এলাকা তো, আলো পড়ে এলেই এখানে বাঘের ভয়। আর ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গেলে রোজই সন্ধে হয়।
এলেহার মোড়লের প্রতিবেশী নসিম মোল্লার জিজ্ঞাসা, ‘‘মাঠের কাজ সামলাব, নাকি সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ব্যাঙ্কের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব?’’ দুই স্ত্রী, চার ছেলে, চার বউমা আর নাতি-নাতনি নিয়ে ২১ জনের পরিবার নসিম মোল্লার। জমি-জিরেতের ভার ছেলেদের উপর ছেড়ে বছর কয়েক ভারমুক্ত ছিলেন নসিম। বয়সের ভারে কিছুটা অশক্তও তিনি। ক্ষেত-খামারের পরিশ্রম আর সহ্য হয় না। কিন্তু কালো টাকার বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদী দিল্লি থেকে যে পন্থায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তাতে বাসন্তীর প্রত্যন্ত গ্রামে বৃদ্ধ নসিমকে ফের অশক্ত শরীর নিয়ে ধানক্ষেতে নামতে হয়েছে।
নসিম মোল্লা বললেন, ‘‘ধান কাটার সময় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাটার লোক পাচ্ছি না। বাগানবাড়ির (সব্জি চাষ) মরশুমও এসে গিয়েছে। তার জন্যও লোক নেই। নগদ মজুরি না দিলে এখন কেউ কাজ করতে চাইছে না। কিন্তু মজুরি এখন দেব কী ভাবে? এক পয়সা হাতে নেই। নিজেদেরই সব করে নিতে হচ্ছে।’’ হাটে-বাজারে ধার-বাকি করে কোনওক্রমে এখন দিন গুজরান নসিমদের।
আচমকা মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে নসিম মোল্লাদের।
সওকত লস্করের আবার অন্য সমস্যা। নিজের ছোট্ট মুদি দোকান। মূলত পাড়ার লোকজনের সঙ্গেই কেনাবেচা। নোট সঙ্কট শুরু পর থেকে মালপত্র যা বিকোচ্ছে, সবই খাতায় লিখে রাখতে হচ্ছে। পয়সা এখন কেউ দিচ্ছেন না। তবে সেটুকু বিকিকিনিও খুব তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ দোকানের পসরাও ফুরিয়ে আসার পথে। মহাজন আর রসদ জোগাবেন না। কারণ আগের দেনা এখনও শোধ হয়নি সওকতের।
মুম্বইতে ছোটখাট কাজ করেন সওকত লস্করের ছেলে। বাড়ি এসেছিলেন। ফেরার সময় হয়েছে। মুম্বইয়ের টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাসন্তী থেকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছনোর এবং মুম্বই গিয়ে অন্তত কয়েক দিনের হাতখরচটুকু চালানোর মতো পয়সাও ঘরে নেই। সওকত এবং তাঁর ছেলেরা গত কয়েক দিন ধরে পালা করে ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। কিন্তু কাজ মিটছে না। ফতুয়ার পকেট থেকে একজোড়া পাঁচশোর নোট বার করে সওকত বললেন, ‘‘এই দু’টো ভাঙাতে গিয়েছিলাম ব্যাঙ্কে। পারলাম না। কখনও বলছে টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে, কখনও বলছে সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্কের লোক আমাদের সঙ্গে মোটেই ভাল ব্যবহার করছে না।’’
ভরতগড় পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্চিতা মণ্ডল বর জানালেন, গোটা এলাকাতেই একই ছবি। ঘরে ঘরে হাহাকার। বললেন, ‘‘আমার পঞ্চায়েতে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিম্নবর্তী। দিন আনি-দিন খাই অবস্থা। নোটের অভাবে তাঁরা মজুরি পাচ্ছেন না। এ বেলা খাওয়া জুটছে তো ও বেলা জুটছে না।’’
বাসন্তী ব্লক প্রশাসন সূত্রের খবর, সাড়ে তিন লক্ষের কাছাকাছি জনসংখ্যা গোটা ব্লকে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা মাত্র ৯টি। সম্প্রতি কয়েকটি বেসরকারি ব্যাঙ্কও শাখা খুলেছে। মাত্র এই ১০-১২টি ব্যাঙ্ক শাখা যে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের সঙ্কট কাটানোর পক্ষে মোটেই পর্যাপ্ত নয়, সে কথা ব্লক প্রশাসনও স্বীকার করে নিচ্ছে।
শুধু বাসন্তীর ছবি কিন্তু এটা নয়। গদখালি ঘাট থেকে দুর্গাদোয়ানি নদী পেরিয়ে গোসাবা পৌঁছলে পরিস্থিতি আরও খারাপ। মাইলের পর মাইল ব্যাঙ্কের দেখা মেলে না। নদী-নালা-খাঁড়ি-জঙ্গল পেরিয়ে ১০, ১৫ বা ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী ব্যাঙ্ক বা এটিএমে যখন-তখন পৌঁছে যাওয়াও গোসাবায় খুব সহজ বিষয় নয়। ফলে নোট বাতিলের পরে সেখানকার মানুষ আরও সঙ্কটে।
পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল, বাঁকুড়া ও বীরভূমের একাংশ, মালদহ এবং দুই দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গলে ঢাকা ডুয়ার্সের বড় অংশ— সর্বত্র এখন সমস্যার ছবিটা একই রকম। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা থেকেও একই রকম সমস্যার ছবি উঠে আসছে জাতীয় সাংবাদমাধ্যমে। ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামোর দুর্বলতায় নোট সঙ্কটে নাভিশ্বাস ওঠার দশা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের। ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগঢ়, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামো তো রাতারাতি গজিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। অতএব সঙ্কট সেখানেও।
আরও পড়ুন: ‘কেস খা না হলে পাঁচশো টাকার নোট ভাঙিয়ে দিয়ে যা’
শহরাঞ্চলে কিন্তু সমস্যা এত প্রকট নয়। কলকাতার মতো বড় শহরে তো বটেই, অন্যান্য মাঝারি মাপের শহরেও ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামো বেশ উন্নত। ফলে আচমকা নোট বাতিল এবং বিকল্প নোটের অপ্রতুল জোগানের ধাক্কা শহরের মানুষের গায়ে সে ভাবে লাগেনি এখনও। যতটুকু সঙ্কট রয়েছে, কালো টাকা আর জাল টাকা নির্মূল হওয়ার মতো বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সেটুকু সঙ্কট মেনে নিতে অনেকেই প্রস্তুত। কিন্তু বিস্তীর্ণ গ্রামীণ ভারতে সাধারণ জনজীবন এখন আক্ষরিত অর্থেই পঙ্গু। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬৯ শতাংশ গ্রামে থাকেন। তাঁদের জন্য এটিএমের সংখ্যা ৪০ হাজারের কিছু বেশি। আর শহর ও শহরতলিতে থাকেন ৩১ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ। তাঁদের জন্য এটিএম প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার। এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয়ে যায় নোট বাতিলের ধাক্কাটা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে কী ভয়ঙ্কর আঘাত করেছে। ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামোর নিরিখে প্রায় নেই-রাজ্যে বাস যে মানুষগুলোর, টাকা বদলানোর সংস্থান করতে এখন তাঁদের দিশাহারা দশা। আচমকা আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথায়।
ছবি ও ভিডিও: অজয়শঙ্কর রায়।
গ্রাফিক্স: সোমনাথ মিত্র।