মেটিয়াবুরুজ এলাকার লিচুবাগান বস্তির এক চিলতে ঘরটায় রবিবার দুপুর থেকেই ভিড় করছিলেন মহিলারা। তাঁদের অনেকেরই যে সম্মান বেঁচেছিল নজরুল ইসলামের সাহস ও তৎপরতার জন্য। বিদ্যুৎ চুরির প্রতিবাদ করতে গিয়ে নজরুল শুক্রবার রাতে দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়ে গিয়েছেন। এলাকার মহিলাদের মধ্যে এখন আতঙ্ক, এর পর কে বাঁচাবে তাঁদের? খুনে অভিযুক্ত পাঁচ দুষ্কৃতীর মধ্যে চার জনই এখনও অধরা।
অভিযুক্তদের এক জন শেখ আলম কেবল ধরা পড়েছে। নাসিম, আহমেদ, ইকবাল ও দইয়ান ফেরার। এরা প্রত্যেকেই লিচুবাগান বস্তিরই বাসিন্দা। নিহত নজরুলের স্ত্রী সালমা ও তাঁর দেওর পারভেজ ইসলামের দাবি, ‘‘ওরা সবাই এলাকাতেই রয়েছে। অথচ পুলিশ নাকি খুঁজে পাচ্ছে না। মেটিয়াবুরুজ থানার উপর আমাদের আস্থা নেই। তদন্তের দায়িত্ব সরাসরি লালবাজার নিক।’’ সোমবারের মধ্যে দোষীরা ধরা না পড়লে ওঁরা থানা ঘেরাও করবেন, পথ অবরোধে নামবেন বলে ঠিক করেছেন। ডিসি (বন্দর) সুদীপ সরকারকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। কাউকে ছাড়ার প্রশ্ন নেই।’’ কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও দোষীরা ধরা পড়বে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। রবিবার তিনি বলেন, ‘‘বিধায়ক ও স্থানীয় কাউন্সিলর নিহতের বাড়ি গিয়েছেন। অভিযুক্তরা যাতে ধরা পড়ে, সেই জন্যও ওঁরা উদ্যোগী হয়েছেন।’’
নিহতের স্ত্রীর গলায় কিন্তু ঝরে পড়ছে অভিমান। সালমা দুঃখ করে বলেছেন, ‘‘আমার স্বামী বরাবর অসামাজিক কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। অথচ আমার স্বামী খুন হওয়ার পর সমাজের গণ্যমান্য কেউ আমাদের পাশে নেই!’’ সদ্যবিধবার প্রশ্ন, ‘‘এক স্কুলছাত্রের মৃত্যুর সুবিচার চেয়ে গোটা একটা সপ্তাহ জুড়়ে কত মোমবাতি মিছিল, প্রতিবাদ হল। আমিও দুই সন্তানের মা। আমিও চাই, ওই বাচ্চা ছেলেটা সুবিচার পাক। কিন্তু আমাদের পাশে কেউ দাঁড়ালেন না! সেটা কি আমরা গরিব বলে?’’
এই অভিমান গোটা এলাকারই। নজরুলের পড়শি, তরুণী সালহা খাতুনের কথায়, ‘‘এটা তো শহরের ঝকঝকে অভিজাত এলাকা না। বাইরের কাকে পাশে পাব?’’ প্রায় একই ভাবে উদ্বিগ্ন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানও। তাঁরও প্রশ্ন, ‘‘অভিজাত পরিবারের নাবালক পুত্রের মৃত্যুতে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, প্রায় ততটাই মর্মান্তিক ঘটনায় বিধ্বস্ত কোনও গরিব পরিবারের জন্য মহানগরীর হৃদয় উদ্বেগে কেঁপে উঠল না?’’
শনিবার আবেশের জন্য শহরে মৌনী মিছিলে যাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হেঁটেছেন, তাঁদের অনেকেই অবশ্য বলছেন প্রতিবাদ সংগঠিত হলে তাঁরা যাবেন। সমাজকর্মী মীরাতুন নাহার যেমন বললেন, ‘‘কোনও সংগঠন প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করলে আমি তাতে যোগ দেব, যদি না কোনও ব্যস্ততা থাকে।’’ শিল্পী ওয়াসিম কপূরও বলেন, ‘‘কোনও সংগঠন প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করলে আমি রাস্তায় নামব।’’
নজরুলের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে প্রতিবেশীদের অবশ্য কোনও আয়োজক বা সংগঠকের দরকার হয়নি। তাঁরা নিজে থেকেই পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের এক জন দুলাল মোল্লা বলছিলেন, ‘‘দিন দশেক আগে আমার পনেরো বছরের ছেলেটা অসুখে মারা গেল। তখন নজরুল আমার হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘রেখে দাও। কাজে লাগবে।’ আজ ও নেই। ভাবতে পারছি না।’’ মহিলারা বলছেন, ‘‘আমাদের সম্মান রক্ষায় নজরুল বরাবর এগিয়ে আসতেন। এ বার ইভটিজিং থেকে মহিলাদের বাঁচানোর মতো এই বস্তিতে কেউ থাকল না। সেটাই ভয়।’’
৩ প্রতিবাদীর উপরে হামলা
দুই জেলায় আক্রান্ত হলেন তিন প্রতিবাদী। আবাসন নির্মাণের জন্য এলাকার একটি খেলার মাঠ দখলের চেষ্টা করছেন প্রোমোটার, এই অভিযোগে চুঁচুড়ার শ্যামবাবুর ঘাট এলাকার বাসিন্দারা এককাট্টা হয়েছেন আগেই। তাঁদের সঙ্গে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার ‘অপরাধে’ রবিবার ওই এলাকার বাসিন্দা, ফরওয়ার্ড ব্লকের হুগলি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রবীর রায় ওরফে ঝন্টুকে রাস্তায় ফেলে মারধর ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠল প্রোমোটারের লোকজনের বিরুদ্ধে। রক্তাক্ত প্রবীরবাবুকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁর বুকের ডান দিকের হাড় ভেঙেছে। হাওড়ার উলুবেড়িয়ার মৌবেশিয়া গ্রামে মদ খেয়ে এক দোকানির অভব্য আচরণের প্রতিবাদ করে শুক্রবার প্রহৃত হন জহুরুল হক মির ও তাঁর ভাই। রবিবার তাঁদের লক্ষ করে বোমা ছোড়া হয় ও তাঁদের পঞ্চায়েত সদস্যার বাড়ি যেতে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। কেউ হতাহত হননি।