বিতর্কিত এই ভবন ঘিরেই উঠেছে প্রশ্ন। ছবি: সন্দীপ পাল।
পার্কিং নিয়ে বামেদের এগিয়ে পিছু হটার কাহিনীর শুরু ২০০২ সালে।
তখন জমজমাট বাম রাজত্ব। পুরমন্ত্রী তথা শিলিগুড়ির বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য যেন অলিখিত উত্তরবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। অন্তত, রাজনৈতিক দলের অন্দরে এমনই চর্চা ছিল। সেই আমলে শিলিগুড়ি শহরের ৫টি প্রধান রাস্তা, হিলকার্ট রোড, বিধান রোড, সেবক রোড, বর্ধমান রোড ও স্টেশন ফিডার রোডের যানজট কমাতে কলকাতার বড় মাপের ‘পার্কোম্যাট’-এর আদলে হাসমি চকে একটি ‘পার্কিং প্লাজা’ গড়ার কথা ঘোষণা করা হয়। খোদ তৎকালীন পুরমন্ত্রী অশোকবাবুর ঘোষণা বলে কথা! রেলের কাছ থেকে হাসমি চকের বিশাল জমি লিজ নিয়ে প্রকল্পের কাজ করতে উদ্যোগী হয় শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এসজেডিএ)। যে সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন অশোকবাবুই।
পরের বছর, মানে ২০০৩ সালে অশোকবাবু এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দেন, কলকাতার ধাঁচে অত বড় পার্কো ম্যাট করলে শিলিগুড়িতে লাভজনক হবে না। তাই নিচে পার্কিং হবে ও ওপরে শপিং কমপ্লেক্স হবে। ইতিমধ্যে রেলের থেকে জমি লিজ নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ওই প্রকল্পের কাজে নামে এসজেডিএ।
কিন্তু, পার্কিংয়ের জন্য জায়গা নিয়ে কেন শপিং মল তৈরির জন্য বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হল তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন ওঠে। যুব কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিধান রোডের পাশে, স্টেডিয়ামের রাস্তা চওড়ার জন্য ওই বাণিজ্যিক বহুতলের কিছুটা অংশ ভাঙতে হবে বলে আন্দোলন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ওই বহুতলের কিছুটা অংশ ভাঙার নির্দেশ দিতে হয় এসজেডিএ-কে।
এখানেই শেষ নয়, হাসমি চকের মতো জায়গায় রেলের জমিতে যদি ৪০০টি গাড়ি রাখার মতো বহুতল পার্কিং হতো তা হলে শহরের ৫টি প্রধান রাস্তার চেহারা যে বদলে যেত তা মানছেন প্রায় সকলেই। কারণ, হাসমি চক থেকে ওই রাস্তাগুলির দূরত্ব এমন কিছু নয়। তা নিয়ে শহরের বিদ্বজ্জনেরাও নানা সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাজ্যের অন্যতম বিখ্যাত সাহিত্যিক তথা গবেষক অশ্রু কুমার সিকদার, যিনি আদতে শিলিগুড়ির বাসিন্দা, তিনিও ওই এলাকায় এমন বহুতল গড়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করেছেন।
ঘটনাচক্রে, এখন অশোকবাবু শিলিগুড়ির মেয়র। বর্তমান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব হলেন এসজেডিএ-এর চেয়ারম্যান। নানা সময়ে ওই পার্কিংয়ের জায়গায় কেন বহুতল গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এসজেডিএ তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গৌতমবাবুও। তৃণমূল বিধায়ক গৌতমবাবুকে একাধিকবার বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমি যখন ওই এলাকা দিয়ে যাই, তখন খারাপ লাগে। ওখানটায় এমন শপিং মল করার ভাবনাটা ঠিক নয়।’’ এর পরে গত পুরভোটের আগে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবুকেও প্রকাশ্যে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘হাসমি চকের ওই জায়গায় শপিং মলের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হয়নি। ওই সিদ্ধান্তটা ভুল। আমি মানছি ওটা ভুল হয়েছে। ওখানে ওই শপিং মলের পরিকল্পনা না করাই ভাল হতো।’’
ঘটনা হল, ওই শপিং মল এখনও সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। উপরন্তু, যে সংস্থার সঙ্গে এসজেডিএ-এর যৌথ উদ্যোগে কাজটা হচ্ছে, সেই নির্মাতা সংস্থাও শিলিগুড়ি বাসীর স্বার্থে প্রয়োজনে প্রকল্প থেকে সরার ইঙ্গিত দিয়েছে। ওই নির্মাতা সংস্থার এক কর্তা জানান, যে পরিমাণ টাকা তাঁরা বিনিয়োগ করেছেন তা ফেরৎ পাওয়া নিশ্চিত হলে প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার কথা তাঁরা ভাববেন।
ওই নির্মাতা সংস্থার অন্যতম কর্তা হলেন নিরঞ্জন মিত্তল। শিলিগুড়িতে মিত্তল পরিবারের তরফে অতীতে বাস টার্মিনাস তৈরি হয়েছে। তাতে ডুর্য়াস বাস স্ট্যান্ডের তীব্র যানজটের সমস্যা অনেক কমেছে। ফলে, শহরের পার্কিং সমস্যার সমাধানের কাজে গতি আনতে ফের নির্মাতা সংস্থাটি ফের শপিং মল তৈরির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচিনা করবে বলে আশা করছে শিলিগুড়ি নাগরিক সমিতি। সমিতির মুখপাত্র দূর্গা সাহা বলেন, ‘‘আমরা চাই ওই শপিং মল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে পুনর্বিবেচনা হোক। নির্মাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে এসজেডিএ, পুরসভা নিমির্য়মান অংশটি ভেঙে গোটা এলাকায় পার্কিং প্লাজা গড়ুক। যদি নির্মাতা সংস্থাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার টাকার অভাব হয় তা হলে শহরবাসীর কাছ থেকে চাঁদা তোলা হোক। সেই কাজে আমরা সাহায্য করব।’’
ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অব নর্থ বেঙ্গলের (ফোসিন) সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাসও মনে করেন, ‘‘হাসমি চকে পার্কিং প্লাজা তৈরি হলে শহরের প্রধান রাস্তায় যথেচ্ছ যানবাহন পার্কিংয়ের প্রবণতা কমবে। সে ক্ষেত্রে পুরসভা-পুলিশ-প্রশাসন কড়া ব্যবস্থা নিতে পারবে। সেই সঙ্গে সরকারি আয়ও বাড়বে।’’
সম্প্রতি নাগরিক সমিতি পুরসভার মেয়রকে সম্বর্ধনা দেওয়ার সময়ে যে সব আর্জি পেশ করেছে তার মধ্যে অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে পার্কিং সমস্যা। সেখানে হাসমি চকের ওই শপিং মলের জায়গায় পুরোপুরি পার্কিং প্লাজা গড়ার জন্য আর্জি জানানো হয়েছে। ওই দাবিপত্র হাতে নেওয়ার পরে অশোকবাবুর মন্তব্য, ‘‘সব দিক ভেবে দেখে পদক্ষেপ করব।’’ শিলিগুড়ি শহরের নাগরিকদের অনেকেই মনে করেন, যদি পার্কিংয়ের সমস্যা মেটাতে হাসমি চকের বহুতলের জায়গায় পূর্ব ঘোষণা মতো ‘পার্কোম্যাট’ গড়তে না পারে এসজেডিএ, তা হলে কেন পারবে না তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা দরকার। যদি পারে, তা হলে কতদিনের মধ্যে কী ভাবে তা হতে পারে সেটাও জানানো জরুরি। এসজেডিএ, পুরসভা হাসমি চকে পার্কিং প্লাজা গড়ার ব্যাপারে আদতে পদক্ষেপ করে কি না, সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে নাগরিক সমাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy