Advertisement
E-Paper

বরাত চূড়ান্ত হলেই দিতে হয় ‘পাওনা’

সরকারি অফিস নয়। রেলের বরাতে অংশ নিতে গেলে আগে ‘পার্টি অফিসে’ দেখা করাটাই এনজেপি-র অলিখিত নিয়ম। এই এলাকায় সিন্ডিকেট রাজের দৌরাত্ম্য এমনই।

কৌশিক চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:২৫
শুখা মরসুমে বন্যা রুখতে বঁাধ তৈরির কাজ চলে। এমন কাজেই অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেটের খবরদারির।

শুখা মরসুমে বন্যা রুখতে বঁাধ তৈরির কাজ চলে। এমন কাজেই অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেটের খবরদারির।

সরকারি অফিস নয়। রেলের বরাতে অংশ নিতে গেলে আগে ‘পার্টি অফিসে’ দেখা করাটাই এনজেপি-র অলিখিত নিয়ম। এই এলাকায় সিন্ডিকেট রাজের দৌরাত্ম্য এমনই।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিযোগ, উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের স্ক্র্যাপ বা লোহা-লক্করের নিলাম এবং ওয়াগন খালি করার প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে রয়েছে এই সিন্ডিকেট। রোজকার ‘ওয়েলফেয়ার ফান্ড’ বা বিভিন্ন ‘ব্যবসা’ থেকে আদায় করা টাকার তুলনায় নিলাম বা ওয়াগন খালি করার কাজে প্রতি মাসে আদায় হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা। বিরোধী দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতার কথায়, ‘‘ওই টাকার বড় অংশই এলাকায় শাসক দলের কিছু নেতার পকেটে যাচ্ছে। প্রতি মাসে এই টাকার অঙ্কটা কম করেও ২৫-৩০ লক্ষ টাকায় পৌঁছচ্ছে।’’ এমন দাবি এলেকার অনেকেরই। স্থানীয় এক প্রবীণ ঠিকাদারের কথায়, ‘‘এনজেপি এ ভাবেই চলছে। যখন যে ক্ষমতায় থাকে, তার হাতেই থাকে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ। টাকা যায় তার পকেটে।’’

কিন্তু সে কথা নিয়ে কেউই বেশি নাড়াচাড়া করেন না। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে এনজেপি এলাকায় ‘কর্তৃত্ব’ নিয়ে দুই পক্ষের গোলমাল রাস্তায় এসে গিয়েছে। আর তা থেকেই সিন্ডিকেটের একের পর এক কাজকর্ম প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এলাকার দখল, সংগঠন থেকে টাকা আদায়, সবই জড়িয়ে পড়েছে লড়াইয়ে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়েছে যে, বুধবার বিদায়ী মন্ত্রী গৌতম দেব দুই পক্ষকে বাড়িতে ডেকে মীমাংসার চেষ্টা করেছেন। তার পরের ২৪ ঘন্টায় গোলমাল রাস্তায় না নামলেও ভিতরে ভিতরে চাপানউতোর চলছেই। বিদায়ী মন্ত্রী টাকা পয়সা-সিন্ডিকেট কোনও কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন। এ দিন গৌতমবাবুর দাবি, ‘‘আমার এ সব জানা নেই। শুধু আমাদের লোকজনের মতপার্থক্য হয়েছে মাত্র। আলোচনায় সব মিটে গিয়েছে।’’ আর তৃণমূলের আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি অরূপরতন ঘোষ বলেছেন, ‘‘সব ভিত্তিহীন কথাবার্তা। ও সব এক টাকাও সংগঠনের তহবিলে আসে না। দলের বদনাম করতে রটানো হচ্ছে।’’

শাসক দলের নেতাদের একাংশই অবশ্য জানাচ্ছেন, চোরাই তেলের ব্যবসার পাশে রেলের নিলামের ঠিকাদারি থেকেই এনজেপিতে সিন্ডিকেটের জন্ম। উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের অধিকাংশ পুরানো লোহা লক্কর-সহ বিভিন্ন পুরানো জিনিসপত্রের নিলাম হয় এনজেপিকে কেন্দ্র করেই। বিহারের ঠিকাদার থেকে উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ঠিকাদারেরা নিলামে যোগ দেন। কিন্তু তাঁদের সকলকে নিলামে যোগ দেওয়ার জন্য প্রথমে সিন্ডিকেট দফতরে হাজির হওয়ার নিয়ম চালু করা হয়েছে। এদের মধ্যে যাঁরা বরাতের অঙ্কের ১০-১৫ শতাংশ টাকা দিতে রাজি থাকেন, তাঁদেরই নিলামে অংশ নিতে দেওয়া হয়। বরাত চূড়ান্ত হতেই টাকা জমা করে দিতে হয় সিন্ডিকেটে। না হলে বরাত তো দূরের কথা, এনজেপি এলাকায় ঢোকার অধিকার মেলে না বলে দাবি। দীর্ঘদিন ধরেই এই নিয়ম এনজেপিতে কার্যকরী রেখেছে সিন্ডিকেটের মাথারা। ব্যবসা নষ্ট হওয়ার ভয়ে ঠিকাদারেরাও পুলিশ বা রেলে’র কাছে অভিযোগও জানান না বলে অভিযোগ।

এনজেপি এলাকায় দাড়িয়ে আছে তেলের ট্যাঙ্কার।
এই এলাকার অনেক জায়গাতেই চোরাই তেলের কারবারের সিন্ডিকেট চলে বলে অভিযোগ।— নিজস্ব চিত্র।

এরই সঙ্গে জড়িয়েছে মালগাড়ির ওয়াগন খালি করা বা নির্দিষ্ট সময় ট্র্যাকে রাখা নিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও। সিন্ডিকেটের নীচের তলায় থাকা সদস্যরা জানিয়েছেন, এনজেপিতে লোহা, সিমেন্ট-সহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দিনে কম করে ৫০টির বেশি মালগাড়ির ওয়াগন খালি করা হয়। কিন্তু মালগাড়িগুলি বেশিরভাগ সময়ই নির্দিষ্ট সময়ে চলে না। তাই এনজেপিতে পৌঁছানোর পর ওয়াগন খালি করতে সময় বেশি লেগে যায়। কিন্তু রেলের নিয়ম অনুসারে, ওয়াগন খালি করতে দেরি হলেই তার জন্য ‘লেট ফি’ দিতে হয়। যার টাকার অঙ্ক মোট জিনিসপত্রের হিসাবে লক্ষাধিক টাকা দাঁড়িয়ে যায়। এখানেই শুরু হয় সিন্ডিকেটের কাজ।

নিজেদের সংগঠনের কুলি, মুটে, গাড়ি তৈরি রাখা ছাড়াও, সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করে ওয়াগন সময়সীমার মধ্যে খালি করে দেওয়ার জন্য প্রত্যেক পার্টির কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। সেখানে লেট ফি গুণতে হলে পার্টিকে এর কয়েকগুণ টাকা দিতে হয় বলে তাঁরাও সিন্ডিকেটের উপরই ভরসা করে আসছেন। তার জেরে ফুলফেঁপে উঠছে সিন্ডিকেট। আর গোটা প্রক্রিয়া ঠিক ভাবে চালিয়ে যেতে সিন্ডিকেটের তরফে ‘স্পেশালিস্ট’ লোকও নিয়োগ করা হয়। এনজেপিতে ৩ বছর আগেও ঠিকাদারদের সংগঠন সক্রিয় ছিল। এখন তা আর নেই। এলাকার কয়েকজন ঠিকাদারের কথায়, ‘‘সবই তো জানেন। টাকা দেওয়া ছাড়া কাজ করা মুশকিল। আমরা করে খাই। গোলমালে কে যেতে চায় বলুন।’’

দলের নেতাদের কয়েকজন জানান, সিপিএম আমলে এনজেপি স্ট্যান্ড এলাকায় সিটুর দফতর থেকে এনজেপি’কে নিয়ন্ত্রণ করা হত। তৃণমূল আমলে এনজেপির তিন মাথায় তিনটি আলাদা দফতর খুলে প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা আলাদা লোক নিয়োগ করে এলাকার কর্তৃত্ব নেওয়া হয়েছে বলে দাবি।

final assignment Sand
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy