E-Paper

‘জঙ্গলের গাছ ছুঁয়ে ও আর কখনও আসবে না’

পিচ রাস্তা ধরে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে সে সেদিন শুনেছিল, অর্জুনকে একটি হাতি নাকি মেরেছে, সে হাসপাতালে ভর্তি।

অনির্বাণ রায়

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:৫৮
হাতির হানায় মৃত পরীক্ষার্থী অজুর্ন দাসের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ সারছেন বাবা বিষ্ণু দাস, জঙ্গলের পাশেই। ছবি: সন্দীপ পাল

হাতির হানায় মৃত পরীক্ষার্থী অজুর্ন দাসের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ সারছেন বাবা বিষ্ণু দাস, জঙ্গলের পাশেই। ছবি: সন্দীপ পাল

উঁচু-নিচু মেঠো পথ, আল জমি, সামনে ছড়ানো মাঠ ডিঙিয়ে দৌড়ে কে আগে জঙ্গলে পৌঁছতে পারে! শাল, পিয়াল কিংবা জারুল যে কোনও গাছ ছুঁয়ে আবার ফিরে আসতে হবে পিচ রাস্তায়। কে কার আগে জঙ্গল ছুঁয়ে ফিরে আসতে পারে, এই ছিল ওদের অবসরের প্রিয় খেলা। মাধ্যমিক পরীক্ষার শুরু দিনে এমন কোনও খেলা ছিল না। তবে ওদের দু’জনেরই তাগিদ ছিল পরীক্ষা কেন্দ্রে ঠিক সময়ে পৌঁছনোর। এক জন বেছে নিয়েছিল পিচের রাস্তা। অন্য জন বেছেছিল জঙ্গলের পথ, যে পথে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তার আর পৌঁছনো হয়নি গন্তব্যে। যে জঙ্গলে সে কত বার গিয়েছে, কত বার সে গাছ ছুঁয়ে ফিরে আসার খেলায় মেতেছে বন্ধুর সঙ্গে বাজি রেখে, সেই জঙ্গল-পথেই তার প্রাণ কেড়েছে হাতি।

কিছুতেই ভুলতে পারছে না মৃত অর্জুন দাসের সহপাঠী। মুখোমুখি বাড়িতে থাকে দু’জনে, পিঠোপিঠি জন্মও। পিচ রাস্তা ধরে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে সে সেদিন শুনেছিল, অর্জুনকে একটি হাতি নাকি মেরেছে, সে হাসপাতালে ভর্তি। শুনে পরীক্ষা দিতে চায়নি বন্ধুটি। শিক্ষকেরা জানান, অর্জুন হাসপাতালে, চিকিৎসা চলছে। বন্ধুটির কথায়, পরীক্ষা যখন শেষ হব-হব তখন শিক্ষকদের চাপা গুঞ্জনে ভেসে খবরটি কানে পৌঁছয় তার, অর্জুন বেঁচে নেই। শুনেই হাত কেঁপে উঠেছিল তার। কলম খসে পড়ে গিয়েছিল হাত থেকে। চোখের জল বাঁধ মানেনি। শনিবার বিকেলে পরীক্ষা দিয়ে ফিরে জঙ্গলের দিকে আনমনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই বন্ধু।

অর্জুনের সেই বন্ধুর কথায়, “পরীক্ষা দিচ্ছি ঠিকই। কিন্তু লিখতে পারছি না। খাতার পাতায় অর্জুনের মুখ ভেসে আসছে। তার পর আর লিখতে পারছি না।” হাতির হানায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মৃত্যুর খবরের সঙ্গেই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল অর্জুন দাসের ছবিও। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে অর্জুনের পাশে আরও এক জন, যার শুধু জলপাই রঙের জ্যাকেট-পরা হাতের অংশটুকু দেখা যাচ্ছে। বন্ধু বলছে, “ওই কেটে দেওয়া ছেলেটা তো আমিই। আমিও সমাজমাধ্যমে দেখছি বার বার ছবিটা। এত দিন এক সঙ্গে ছবিতে ছিলাম, এখন অর্জুন একা হয়ে গেল, আমিও একা হয়ে গেলাম।”

অর্জুনের স্কুলের প্রধানশিক্ষক সমীর সেন বলেন, “পড়ুয়াদের সকলে যেন ভাল করে পরীক্ষা দেয়, সেটা বুঝিয়েছি ওদের।” জলপাইগুড়ি হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক তথা মনোবিদ আশিস সরকার বলেন “বন্ধুরা শোক এবং কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। অভিভাবকদের বলব ওদের সঙ্গে হাসিখুশির মধ্যে রাখতে। পড়াশোনায় বা অন্য কাজে যত মন বসবে ততই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে।”

অর্জুনের বাড়ি থেকে কয়েক পা হাটলে আর এক বন্ধুর বাড়ি। এলাকায় তিন বন্ধুকে সব সময় এক সঙ্গে দেখা যেত। বাড়ির লোকের বকুনি উড়িয়ে বাইক চালানো থেকে শুরু করে পুকুরে স্নান করা, জঙ্গলে গিয়ে গাছে উঠে পড়া সবেতেই তিন জন এক সঙ্গে। সেই বন্ধুটির কথায়, “আমাদের ক্লাসের কেউ ভাল করে পরীক্ষা দিতে পারছে না। অর্জুন সারাক্ষণ বকবক করত। অপরিচিতদের সঙ্গে ডেকে কথা বলত। আমরা মাঝে মধ্যে ওকে বলতাম, চুপ কর।’’ ভূগোল পরীক্ষা দিয়ে ফেরা ছেলেটির গলা ধরে আসে, বলে “জঙ্গলের গাছ ছুঁয়ে ও আর কখনও আসবে না।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

elephant attack Jalpaiguri

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy