E-Paper

জমির কাগজ আজও ভিন্‌-দেশে, ‘ব্রাত্য’ পাঁচ গ্রাম

কাজলদিঘি, চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী-নবাবগঞ্জ, নাওতরী-দেবোত্তর— পাঁচটি গ্রাম স্বাধীনতার পর থেকে ‘বিতর্কিত’ বলে পরিচিত ছিল। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ের পরেও জমির খতিয়ান মেলেনি। ফলে, জমি বেচা-কেনা থেকে শুরু করে সরকারি প্রকল্পে কার্যত ‘ব্রাত্য’ পাঁচটি গ্রাম।

অনির্বাণ রায়

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৪৪
জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের দক্ষিণ বেরুবাড়ি পঞ্চায়েতের চিলাহাটি গ্রাম।

জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের দক্ষিণ বেরুবাড়ি পঞ্চায়েতের চিলাহাটি গ্রাম। ছবি: সুদীপ্ত মজুমদার।

জমির ‘কাগজ’ ছাড়াই কেটে গেল ৭৮ বছর। জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্তবর্তী পাঁচটি গ্রামের জমির কোনও কাগজ নেই ভারতবর্ষে। কাজলদিঘি, চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী-নবাবগঞ্জ, নাওতরী-দেবোত্তর— পাঁচটি গ্রাম স্বাধীনতার পর থেকে ‘বিতর্কিত’ বলে পরিচিত ছিল। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ের পরেও জমির খতিয়ান মেলেনি। ফলে, জমি বেচা-কেনা থেকে শুরু করে সরকারি প্রকল্পে কার্যত ‘ব্রাত্য’ পাঁচটি গ্রাম।

রাজ্যের ভূমি সংস্কার দফতরের এক কর্তার কথায়, “ওই পাঁচ গ্রামের জমির সরকারি মানচিত্র বা রেকর্ড ভারত সরকারের কাছে নেই। রয়েছে বাংলাদেশের কাছে। সে কারণেই জটিলতা রয়েছে।” সমাধানের উপায়? “সরকারি ভাবে সমাধানের সহজ উপায়, বাংলাদেশের থেকে জমির কাগজ নিয়ে আসা, কিন্তু…।”

দিন কয়েক আগে সুই নদীর জলে ভেসেছিল কাজলদিঘি। নদী গ্রামে ঢুকেছে বাংলাদেশ থেকে। দুই দেশের মাঝে বেড়া নেই। নদীর দিকে তাকিয়ে ষাট পেরোনো সারদাপ্রসাদ দাস বলেন, “কিন্তু কিন্তু করেই এত বছর কেটে গেল!” এই গ্রামগুলির সম্পূর্ণ রূপে ভারতভুক্তির দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন চলেছে। ‘দক্ষিণ বেরুবাড়ি প্রতিরক্ষা মঞ্চ’ গঠিত হয়েছে। সারদাপ্রসাদ সেই মঞ্চের সম্পাদক। মুচকি হেসে বলেন, “এখন সমাজমাধ্যমে মাঝেমাঝেই দেশের উন্নতির নানা বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। অথচ, আমাদের সমস্যা মেটে না! মাঝে মাঝে মনে হয়, এ দেশ আমাদের নাগরিক বলে মনে করে না।”

পাঁচটি গ্রামই দক্ষিণ বেরুবাড়ি পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের সুমিত্রা অধিকারী বলেন, “জমির কাগজ না থাকায় ওই গ্রামের বাসিন্দারা ‘কৃষকবন্ধু’র মতো প্রকল্পের সুবিধা পান না। জমি কেনা-বেচা করতে পারেন না। জমি বন্ধক রেখে ঋণ নিতে পারেন না। প্রশাসনের কাছে বারবার প্রস্তাব দিয়েছি, একটা রফা করার। কিন্তু দিন-বছর চলে যায়।” গ্রামগুলিতে মূল জীবিকা, কৃষি। জমির খতিয়ান না থাকায় ধান বিক্রিতেও সমস্যায় পড়তে হয় পাঁচটি গ্রামের বাসিন্দাদের। কারণ, জমির কাগজ দেখাতে না পারলে সরকারি পোর্টালে নাম তুলতে সমস্যা হয়। কৃষকদের দাবি, বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ী বা ফড়েদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে হয়।

স্বাধীনতার আগে এলাকাগুলি ছিল বোঁদা থানার অধীনে। দেশ ভাগের পরে, বোঁদা থানা দখল করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনা, দাবি প্রতিরক্ষা মঞ্চের। ১৯৯০ সালে ভারত-বাংলাদেশ সীমানা নির্ধারণ শুরু হলে দেখা যায়, গ্রামগুলি বাংলাদেশের মানচিত্রের অন্তর্গত হয়ে রয়েছে। জোটে ‘বিতর্কিত এলাকা’র (অ্যাডভার্স ল্যান্ড) তকমা। লোকমুখে গ্রামগুলি হয়ে যায় ‘ছিটমহল’। ২০১৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়। পাঁচটি গ্রাম সরকারি ভাবে ভারতের অংশ হলেও, জমির কাগজ এখনও বাংলাদেশে। প্রশাসনিক কর্তাদের দাবি, সে কাগজ না থাকলে কী ভাবে খতিয়ান হবে? সূত্রের খবর, এলাকার জমির সমীক্ষাই হয়নি স্বাধীনতার পরে!

সম্প্রতি গ্রামগুলিতে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন জলপাইগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক প্রদীপকুমার বর্মা। তিনি বলেন, “সমস্যার কথা বিধানসভায় বলব।” জলপাইগুড়ি বিজেপি সাংসদ জয়ন্তকুমার রায়েরও আশ্বাস, “কথাটা লোকসভায় তুলব।” জলপাইগুড়ির জেলাশাসক শমা পারভীন বলেন, ‘‘জমির রেকর্ড প্রস্তুতের প্রক্রিয়া চলছে। সার্বিক প্রস্তাব দফতরেপাঠানো হয়েছে।’’

সে সব শুনে ফের মুচকি হাসেন সারদাপ্রসাদ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Jalpaiguri State Government Projects

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy