Advertisement
১০ মে ২০২৪

গঙ্গাগর্ভে ঘর-জমি, জল বইছে রাস্তা দিয়ে

চরম বিপদসীমার অন্তত ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার জল হু হু করে ঢুকছে জনপদে। গঙ্গাই গিলছে বিঘার পর বিঘা চাষের জমি, সঙ্গে বাড়িঘরেরও অন্তর্জলীযাত্রা চলছে। ফুলেফেঁপে ওঠা গঙ্গার এমনই জোড়া ফলায় মঙ্গলবার ভোর থেকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত মালদহের পারদেওনাপুর-শোভাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকা।

প্লাবিত এলাকা দিয়ে এ ভাবেই চলছে যাতায়াত। — মনোজ মুখোপাধ্যায়

প্লাবিত এলাকা দিয়ে এ ভাবেই চলছে যাতায়াত। — মনোজ মুখোপাধ্যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
পারদেওনাপুর (মালদহ) শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৬ ০১:২৩
Share: Save:

চরম বিপদসীমার অন্তত ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার জল হু হু করে ঢুকছে জনপদে। গঙ্গাই গিলছে বিঘার পর বিঘা চাষের জমি, সঙ্গে বাড়িঘরেরও অন্তর্জলীযাত্রা চলছে। ফুলেফেঁপে ওঠা গঙ্গার এমনই জোড়া ফলায় মঙ্গলবার ভোর থেকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত মালদহের পারদেওনাপুর-শোভাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকা।

এ ছাড়া, পাশেই থাকা কৃষ্ণপুর ও বাখরাবাদের গ্রাম পঞ্চায়েতেরও একাংশ বিধ্বস্ত। এই পরিস্থিতিতে ওই এলাকার অন্তত ১০ হাজার মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। ভাঙনে সহায়-সম্বলহীন শতাধিক পরিবার। তাঁরা কেউ পারলালপুর হাইস্কুল বা কেউ পার অনুপনগর প্রাথমিক স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, টাউনশিপ মোড় থেকে পারলালপুর গঙ্গা ঘাট পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার রাস্তার বেশিরভাগ অংশের উপর দিয়েই জল বইছে। জলের তোড়ে প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনার রাস্তা একাধিক জায়গায় ভেঙে গিয়েছে। সেই ভাঙা অংশে কোথাও গ্রামের মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই অস্থায়ী বাঁশের মাচা তৈরি করে টাকার বিনিময়ে পারাপারের ব্যবস্থা করেছেন। আবার কোনও এলাকায় রাস্তার উপর জলের এমন স্রোত যে, মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে পারাপার করছেন।

কিন্ত এলাকায় এত মানুষ বিপদে পড়লেও প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। অভিযোগ, কোনও ত্রাণ শিবির তো দূরের কথা, ত্রাণের ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়নি। পারদেওনাপুর-শোভাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান মায়া সরকারের অভিযোগ, মানুষের এই বিপদে এ দিন কালিয়াচক ৩ ব্লক বা জেলা প্রশাসনের কোনও আধিকারিকই এখানে আসেননি। কিছু মানুষের বক্তব্য, ‘‘আমরা পুরোপুরি অসহায়।’’

গত ২৯ জুলাই মার্জিনাল বাঁধ ভেঙে কালিয়াচক ৩ ব্লকের বীরনগর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সরকারটোলা ও চিনাবাজার গ্রামের ৫৫টি পরিবারের ঘরবাড়ি গঙ্গায় ভেসে গিয়েছিল। এ ছাড়া আতঙ্কে অন্তত শতাধিক পরিবার তাদের বাড়ির ইট-কাঠ ভেঙে নেয়। তার ২২ দিন পর ফের শনিবার রাতে গঙ্গা সেই বীরনগরেই থাবা বসায়। আরও প্রায় ৬০টি পরিবারের শতাধিক বাড়ি গ্রাস করে। এ বারও আতঙ্কে খোদ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান সহ দু’শোর বেশি পরিবার তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে নেন।

এরই মধ্যে এই ব্লকেরই পারদেওনাপুর-শোভাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুপনগর মৌজায় গঙ্গা ভাঙন শুরু হয়েছিল। মণ্ডলপাড়া, ঘোষপাড়া ও চৌধুরীপাড়া গ্রামের আবাদি জমি সহ বেশ কিছু বাড়িঘরও গিলছিল। কিন্তু এ দিন ভোর থেকে গঙ্গার জলস্তর চরম বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে শুরু করে এবং গোটা পারদেওনাপুর-শোভাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতই প্লাবিত হয়ে পড়ে। সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গঙ্গার চরম বিপদসীমার মাপকাঠি ২৫.৩০ মিটার। সেখানে এদিন ভোর ৬টায় জলস্তর ছিল ২৫.৩৪ মিটার ও বেলা ১২টায় তা হয়ে যায় ২৫.৩৭ মিটার। জলস্তর আরও বাড়বে, ফলে গঙ্গাপাড়ের বাসিন্দারা চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন।

এ দিকে পারদেওনাপুর-শোভাপুর যাতায়াতের প্রধান রাস্তাই হল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের টাউনশিপ মোড় থেকে পারলালপুর ঘাট পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনার রাস্তা। একেই শুরু থেকে চকবাহাদুর পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা পুরোপুরিই বেহাল। এরপর চর সুজাপুরের মণ্ডলপাড়ায় গঙ্গার জল ঢুকে সেই রাস্তার প্রায় ৫০ মিটার অংশ ভেঙে উড়িয়ে নিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারাই বাঁশের মাচা তৈরি করে পারাপারের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু অভিযোগ, কিছু মানুষ ওই পারাপারে মাথাপিছু ৫ টাকা ও মোটরসাইকেল পিছু ১০ টাকা করে আদায় করছে। এরপর পারলালপুর ঘাট পর্যন্ত যত দূর রাস্তা গিয়েছে, তার বেশিরভাগ অংশের উপর দিয়ে জলস্রোত বইছে। কিছু এলাকায় জলের বেগ এতটাই বেশি যে, মানুষ হেঁটে যাতায়াত করতে ভয় পাচ্ছেন। তাই নৌকাতে করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। গোটা পারদেওনাপুর-শোভাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাই এদিন গঙ্গার জলে প্লাবিত হয়েছে।

এদিন সকালে বাড়ি হারিয়ে সুভাষ ও নিখিল চৌধুরী বলেন, ‘‘বাড়ি রক্ষা করতে পারলাম না। সবটাই তলিয়ে গেল।’’ এলাকার গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক আসিফ ইকবালের দাবি, ওই এলাকার অন্তত ১৮০টি পরিবারের বাড়ি গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া বিঘার পর বিঘা হলুদ, শসা চাষের জমি ও আম বাগান গ্রাস করছে গঙ্গা। দুর্গতরা পারলালপুর হাই ও পার অনুপনগর প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নিলেও প্রশাসন কোনও ত্রাণ বিলি করেনি, ত্রাণ শিবিরও খোলা হয়নি। পারলালপুর হাই স্কুলে আশ্রয় নেওয়া গোবিন্দ চৌধুরী, বিজয় চৌধুরী, গায়ত্রী মণ্ডল, হারু ঘোষরা জানান, ঘরবাড়ি হারিয়ে দু’দিন ধরে স্কুলে আছেন তাঁরা, প্রশাসন কোনও ত্রাণের ব্যবস্থা করেনি। এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক বিশ্বনাথ ঘোষ অভিযোগ করেন, ‘‘পারদেওনাপুর-শোভাপুর পুরো সহ কৃষ্ণপুর, বাখরাবাদ ও বীরনগর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের আংশিক এলাকার হাজার হাজার মানুষ গঙ্গার জলে, ভাঙনে বিধ্বস্ত. অথচ ব্লক-জেলা প্রশাসন কারও কোনও মাথাব্যাথা নেই. ত্রাণ বা পুনর্বাসনের কোনও উদ্যোগ নেই।’’ জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদী বলেন, ‘‘প্রশাসন সজাগ রয়েছে। দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিলি করা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flood Water in Road Landslide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE