Advertisement
E-Paper

চোখ বুজেই সেলুষ্ণা দেখেন ধসে হারিয়ে যাওয়া বাড়িটা

‘‘আর তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই এখানেই আসি। চোখ বুজলে মনের মধ্যেই দেখতে পাই, ওই তো আমাদের বাড়ি। উঠোনে বাবা বসে আছে, মা বারান্দায় কাজ।’’ মিরিকের টিংলিঙের প্রাথমিক স্কুলের ত্রাণ শিবির থেকে কিলোমিটার খানেক চড়াই হাঁটলেই পাহাড়ের ঢাল।

সন্দীপ পাল

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৫ ০১:৫৮
এই এলাকাতেই ছিল সেলুষ্ণার (ইনসেটে) বাড়ি।— নিজস্ব চিত্র।

এই এলাকাতেই ছিল সেলুষ্ণার (ইনসেটে) বাড়ি।— নিজস্ব চিত্র।

‘‘আর তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই এখানেই আসি। চোখ বুজলে মনের মধ্যেই দেখতে পাই, ওই তো আমাদের বাড়ি। উঠোনে বাবা বসে আছে, মা বারান্দায় কাজ।’’ মিরিকের টিংলিঙের প্রাথমিক স্কুলের ত্রাণ শিবির থেকে কিলোমিটার খানেক চড়াই হাঁটলেই পাহাড়ের ঢাল। যতদূর চোখ যায় সবুজে সবুজ। সেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল সেলুষ্ণার।

মাসখানেক আগেও অবশ্য স্কুলে ত্রাণ শিবির ছিল না। কচিকাঁচাদের দুষ্টুমিতে স্কুলটাও ছিল চা বাগানের মতো সবুজ। সে সব দেখেই নেপালে দিদির শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন বছর উনিশের সেলুষ্ণা থাপা। ফিরে এসে ঘরের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাননি বছর উনিশের তরুণী। কেবল শুনেছিলেন, রাক্ষুসে ধস সব ভেঙে গুঁড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। নিয়ে গিয়েছে, তাঁর বাবা-মা-ভাই-বোন সকলকেই। যেখানে বাড়ি ছিল, সেখান থেকে কয়েকটি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ত্রাণ শিবিরে পৌঁছেছিলেন প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেলুষ্ণা। সেই থেকে ত্রাণ শিবিরই ঠিকানা মিরিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেলুষ্ণা থাপার।

তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে, এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে ত্রাণ শিবির থেকে কিলোমিটার খানেক চড়াই পথে হেঁটে খাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। সেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়, খানিকটা নীচে পাহাড়ের ঢাল বরাবর মাটি খুবলে যাওয়া জায়গাটি। সেখানেই কিছুদিন আগেও তাঁদের বাড়ি ছিল। দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন সেলুষ্ণা। নীরবে। সন্ধে নামার আগে আবার ফিরে আসেন ত্রাণ শিবিরে। রবিবার দুপুরেও সেলুষ্ণা বলছিলেন, ‘‘কিছুদিন পরে তো শিবিরটাও থাকবে না। তখন কী হবে, কোথায় যাব জানি না।’’


স্বজনহারারা যেমন রয়েছেন, তেমনিই পরিবার নিয়েও মিরিকের ত্রাণ শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন অনেকে।
৩ জুলাই রাতের ধসে বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারও বা বাড়ির পাশ দিয়ে ধসে গিয়েছে মাটি, পাথর, উপড়ে গিয়েছে বড় বড় গাছ।
ভয়ে কেউ গ্রামে ফিরতে চাইছেন না। তাঁদের দাবি, প্রশাসন সুষ্ঠু ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুক। ছবি: সন্দীপ পাল।

গত ৩ জুলাই গভীর রাতে দার্জিলিং পাহাড়জুড়ে যে ধস নেমেছিল, তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মিরিকের টিংলিঙের লিম্বুগাঁও। মৃত্যু হয়েছিল ১৯ জনের। সেখানেই ছিল সেলুষ্ণার বাড়ি। গত মাসের শেষের দিকে নেপালের ধারানে দিদির শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে বসেই ধসের খবর শুনে, গ্রামে ফিরে আসেন। ধসে মৃত্যু হয়েছে সেলুষ্ণার বাবা মোহনলাল থাপা, মা সঙ্গীতাদেবী, ভাই কেওল ও বোন সুবেষ্ণার। তারপর থেকে শুধু সেলুষ্ণাই নয়, স্বজনহারা অনেকেরই এখনও ত্রাণ শিবিরেই দিন কাটছে। টিংলিঙে সাতটিরও বেশি ত্রাণ শিবির চলছে। তার মধ্যে টিংলিঙের প্রাথমিক স্কুলের শিবিরটিই বড়। হাজারখানেক বাসিন্দা ওই শিবিরে রয়েছেন। দু’বেলা রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে আশ্রিতদের। ব্যবস্থা রাখা হয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসা, ওষুধেরও। তার মধ্যেও ত্রাণ শিবিরের ব্যবস্থা নিয়ে নানা অভিযোগ-ক্ষোভও অব্যাহত রয়েছে আশ্রিতদের।

ঘটনার আকস্মিকতা কাটতে থাকায়, এখন পুর্নবাসনের প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছে আশ্রিতদের কাছে। আরও কতদিন ত্রাণ শিবিরে কাটাতে হবে সে প্রশ্নের কোনও উত্তর জিটিএ বা প্রশাসনের আধিকারিকদের জানতে চাইলেও উত্তর মিলছে না বলে অভিযোগ আশ্রিতদের। দার্জিলিঙের জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘কোথাও যেন সমস্যা না হয়, সে জন্য প্রশাসনের আধিকারিকেরা দিনভর ত্রাণ শিবিরে ঘুরছেন। পুর্নবাসনের বিষয়ে এলাকার বিভিন্ন চা বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। দ্রুত সকলের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’’ টিংলিঙের জিটিএ-এর সদস্য অরুণ সিংজির দাবি, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই পুনর্বাসনের কাজ শুরু হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘চা বাগানের ভিতরে একটি জমি চিহ্নিত হয়েছে। ওখানে জিটিএ এবং জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে ৩০টি বাড়ি হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাড়িগুলি বণ্টন করা হবে।’’

সেই আশ্বাসে অবশ্য অনিশ্চয়তা কাটছে না সেলুষ্ণার। মা-বাবা-ভাই-বোন নেই। বাড়ি নেই। দিদির শ্বশুরবাড়ি নেপালে গিয়ে পাকাপাকি থাকাও সম্ভব নয়। সরকারি ক্ষতিপূরণ বিলি শুরু হলেও, তাঁর নামে এখনও কিছু বরাদ্দ হয়নি। প্রশাসনের আধিকারিকদের কাছে ভবিষ্যতে কোথায় থাকবেন তা জানতে চেয়েও উত্তর পাননি। পড়ার খরচ কে জোগাবে তাও জানেন না। গ্রামে যেতে ভয় করে। তাই প্রতিদিন চড়াই পথ হেঁটে, দূর থেকে গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

যেখানে তিন সপ্তাহ আগেও ওঁদের বাড়ি ছিল।

Mirik Relief center Sandip Pal Nepal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy