Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নজর চাই, নজর কই

বাংলাদেশে পরপর জঙ্গিহানা। সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া শুরু হয়েছে এপারেও। স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড— সর্বত্র নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ এসেছে নবান্ন থেকে। সেই সূত্র ধরেই খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, অধিকাংশ জায়গাতেই রক্ষীর সংখ্যা বাড়েনি। কোথাও বিকল মেটাল ডিটেক্টর। কোথাও আবার লাগেজ-স্ক্যানার অকেজো। উত্তরবঙ্গের কিছু ছবি আনন্দবাজারের চোখে। স্টেশনে ঢোকার মুখেই ‘মেটাল ডোর’। তার নীচ দিয়ে ছোট-বড় ব্যাগ নিয়ে স্টেশনে ঢুকছেন যাত্রীরা। তবে যান্ত্রিক ডোরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। ডোরের মাথায় লাগোয়া আলোও জ্বলছে না।

শিলিগুড়ি
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০২:২৭
Share: Save:

স্টেশনে ঢোকার মুখেই ‘মেটাল ডোর’। তার নীচ দিয়ে ছোট-বড় ব্যাগ নিয়ে স্টেশনে ঢুকছেন যাত্রীরা। তবে যান্ত্রিক ডোরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। ডোরের মাথায় লাগোয়া আলোও জ্বলছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল দীর্ঘদিন ধরেই মেটাল ডোর অকেজো। স্টেশনে ঢোকার আরও একটি রাস্তা রয়েছে। সেখানে ব্যাগপত্তর পরীক্ষার জন্য রয়েছে ‘লাগেজ স্ক্যানার’। সেই স্ক্যানারের মনিটরে চোখ রেখে বসে আছেন এক আরপিএফ জওয়ান। অধিকাংশ যাত্রী কিন্তু স্ক্যানারকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। এই নিয়ে প্রশ্ন করতেই জওয়ান বললেন, ‘‘একা কত দিক দেখব। ওটা আমার কাজ নয়।’’ এটাই নিউ জলপাইগুড়ি (এনজেপি) স্টেশনের ছবি। উত্তর-পূর্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন, যেখানে শনিবার রাজধানী এক্সপ্রেস এসে দাঁড়ানোর সময় মাত্র এক জন নিরাপত্তারক্ষীকে দেখা গিয়েছে। সদা ব্যস্ত এই স্টেশনের বাইরে পার্কিং লটে রাখা শয়ে শয়ে গাড়ি, সাইকেল-বাইকও তল্লাশির ব্যবস্থা নেই।

উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে রাজ্যের যোগাযোগের অন্যতম জংশন শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডে শনিবার দীর্ঘক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও কোনও নিরাপত্তা রক্ষীই দেখা গেল না। ট্রেনে যদি বা কিছু পাহারা থাকে, বাসে চেপে হিল্লি-দিল্লি করলেও ধরা পড়ার আশঙ্কা অনেক কম। অথচ তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডে নজরদারির নামগন্ধ নেই। অথচ এখান থেকে উত্তরবঙ্গ, দেশেরও নানা জায়গায় বাস যাচ্ছে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই বাসে চেপে অন্যত্র চলে যেতে পারবেন। জংশনে ঢোকার চারটে প্রবেশ পথে নিরাপত্তা কর্মীদের দাঁড়ানোর যে স্ট্যান্ডগুলি রয়েছে, সেগুলি সবই তালাবন্ধ।

বাসস্ট্যান্ডের কাছেই শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন। নেপাল সীমান্ত এলাকা ছুঁয়ে আসা ট্রেন প্রতিদিন আসছে এই স্টেশনে। এই স্টেশনেও যাত্রীদের ব্যাগ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। ক’দিন হল এই স্টেশনের স্ক্যানার মেশিন বিকল হয়ে পড়েছে।

শহরের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার চেলিং সিমিক লেপচা বলেন, ‘‘কী ভাবে নিরাপত্তা বাড়ানো যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

কোচবিহার

যে কোচবিহার জেলার এক দিকটা জুড়ে রয়েছে অনেকাংশে খোলা বাংলাদেশ সীমান্ত, সেখানে সদর শহরের বাসস্ট্যান্ডে কোনও তল্লাশির বালাই নেই বললেই চলে। দিনহাটা, মেখলিগঞ্জ, তুফানগঞ্জেও বাসস্ট্যান্ডের একই পরিস্থিতি। যাত্রীদের অভিযোগ, কোথায় থেকে কে, কী মালপত্র নিয়ে বাসে উঠছেন, তা পরীক্ষা করে দেখার পরিকাঠামোই তৈরি করতে পারেনি পুলিশ-প্রশাসন। নেই মেটাল ডিটেক্টরও। আর এক সীমান্ত-শহর হলদিবাড়ি থেকে রোজ ২৬টি বাস যাতায়াত করে। সেখানেও বাসস্ট্যান্ডে তল্লাশির বালাই নেই। মাঝেমধ্যে পুলিশ ঘুরে চলে যায়। তাই নিরাপত্তা আরও বাড়ানোর জন্য বাসমালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। একই দাবি জানিয়েছে হলদিবাড়ি পুরসভাও।

হলদিবাড়ি বাস্ট্যান্ডের বাইরে বাজারের কাছে এবং রেলগেটে দুটি পুলিশ পিকেট আছে। সেখানে রাজ্য পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে সিভিক ভলান্টিয়াররা মোতায়েন আছে। আর একটি পুলিশ ভ্যান নিয়মিত বাজার এলাকায় টহল দেয়।

মালদহ

মালদহ শহরের গৌড়কন্যা বাস টার্মিনাসে পুলিশি নিরাপত্তার কোনও বালাই নেই। ভোর হতেই প্রতিদিন বিভিন্ন রুটের সরকারি ও বেসরকারি বাস এই স্ট্যান্ড থেকেই ছাড়ছে এবং ফিরে আসছে। এ দিন দুপুরে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে কোনও পুলিশ কর্মীর দেখা মেলেনি। বেসরকারি বাস কাউন্টারের কর্মী দুলাল বসাক বলেন, ‘‘আমরা সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত এখানে আছি। এ দিন তো কোনও পুলিশকে চোখে পড়েনি। চেকিং তো দূরের কথা। বেলা ১টা নাগাদ ওই স্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন চাঁচলের বাসিন্দা আব্দুর রহিম। বললেন, ‘‘আধ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কোনও পুলিশ তো দেখলাম না।’’ একই কথা গাজোলের আশালতা সরকার, সামসের রেহেনা বানুদের। এসপি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘বাস টার্মিনাস, রথবাড়ি সহ বিভিন্ন জনবহুল এলাকাতে সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ওই সব এলাকায় পুলিশি টহলও হচ্ছে। নিরাপত্তায় কোনও শিথিলতা নেই।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘জনবহুল এলাকা, বাসস্ট্যান্ড, হোটেল সর্বত্রই এ দিন সাদা পোশাকের পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ পুলিশ নজরদারি চালিয়েছে। কয়েকটি পয়েন্টে গাড়ি থামিয়ে চেকিংও হয়েছে।’’ বিকেলে দিকে সাহাপুর ব্রিজের দিকে পুলিশকে চেকিং করতে দেখা গিয়েছে।

মালদহ স্টেশনেও এদিন ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থা লক্ষ্য করা গিয়েছে। দুপুরের দিকে স্টেশনে জিআরপি কর্মীদের দফতরের সামনেই ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে। একই ছবি আরপিএফ ক্যাম্পেও। মালদহ জিআরপির আইসি কৃষ্ণগোপাল দত্ত অবশ্য বলেন, ‘‘এ দিন বেশ কয়েকটি ট্রেনেই তল্লাশি চালানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যথেষ্ট জোরদার।’’

উত্তর দিনাজপুর

উত্তর দিনাজপুর জেলায় মোট ২২৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাংলাদেশ সীমান্ত। এবং এই সীমান্তের পুরোটাই কাঁটাতারে ঘেরা। বাংলাদেশে জঙ্গিহানার পর কেন্দ্রের নির্দেশে সীমান্তে বেড়েছে বিএসএফের তৎপরতা। পাশাপাশি, জেলার সমস্ত বাসস্ট্যান্ড, বাজার, রেলস্টেশন-সহ জনবহুল এলাকায় সাদা পোশাকে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন পুলিশ সুপার অমিতকুমার ভরত রাঠৌর। সন্দেহভাজন যাত্রীদের ব্যাগ ও দেহ তল্লাশি করা হচ্ছে। জেলার ৩৪ ও ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চলছে। এসপি জানান, জঙ্গিরা বাংলাদেশ থেকে ঢোকা-বেরনোর পথ হিসেবে যাতে এই জেলাকে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য পড়শি রাজ্য বিহারের পুলিশকেও সতর্ক করে রেখেছে জেলা পুলিশ।

জলপাইগুড়ি

বাংলাদেশে জঙ্গি হানার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই জলপাইগুড়ির বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ড ও রেল স্টেশনে নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলেছেন জেলার পুলিশ কর্তারা৷ কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরো অন্য। শান্তিপাড়া বাস স্ট্যান্ড হোক বা কদমতলা— সর্বত্রই নিরাপত্তা যেন ঢিলেঢালা৷ পুলিশি নজরদারি কিংবা তল্লাশি নজরে পড়া ভার ৷ একই চিত্র জেলার রেল স্টেশনগুলিতেও৷ প্রচুর যাত্রী ট্রেনে চাপছেন কিংবা ট্রেন থেকে নামছেন। কিন্তু তাঁদের ওপর কোন নজরদারি চোখে পড়ে না৷ যদিও জেলা পুলিশকর্তারা দাবি করছেন, বাংলাদেশে জঙ্গি হানার পরিপ্রেক্ষিতে জেলার বাস স্ট্যান্ড ও রেল স্টেশনগুলিতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে ৷

আলিপুরদুয়ার

নিউ আলিপুরদুয়ার, আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশনে পুলিশের টহল রয়েছে। কিন্তু, প্ল্যাটফর্মে নজরদারি প্রায় নেই। কামরায় মালপত্র তোলার সময়েও কোনও পরীক্ষা হয় না। বাস স্ট্যান্ডেও তল্লাশি নিয়মিত নয়। বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই মেটাল ডোর, স্ক্যানার বা মেটাল ডিটেক্টর বলতে কিছুই নেই।

দক্ষিণ দিনাজপুর

গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন বালুরঘাট। অথচ পুলিশের নজরদারি বলে প্রায় কিছুই নেই। রাতে সুনসান স্টেশনে কে আড্ডা জমাচ্ছে, সেটা দেখার কেউ নেই। বাস স্ট্যান্ড চত্বরে এখনও সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে টহল হলেও তল্লাশি বলতে গেলে হয়ই না। হিলি সীমান্তে যাতায়াতকারী বাসেও তল্লাশি বড়ই ঢিলেঢালা।

ছবিগুলি তুলেছেন গৌর আচার্য, অমিত মোহান্ত, বিশ্বরূপ বসাক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Security Passenger Checking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE