মালদহের মানিকচকে মনসা গানের আসরে সাপের ছোবলে মৃত শিল্পীর দেহ কবর থেকে তুলে ফের ওঝা, গুণিনদের ডেকে ঝাড়ফুঁকের চেষ্টা হল। সোমবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে মানিকচকের উৎসবটোলা ঘাটে। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই পড়শি গ্রাম থেকে আসা ওই ওঝা, গুণিনেরা গা ঢাকা দেন।
গ্রামগঞ্জে ওঝা, গুণিনদের আজও রমরমার জেরেই ঘটনার তিন দিন পরেও কবর থেকে দেহ তুলে ঝাড়ফুঁকের চেষ্টা হল বলে মত এলাকার বাসিন্দাদের। সেই সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের ভুমিকা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সাপের কামড়ে মৃত্যু হলেও ময়না তদন্ত করা হয়নি। পুলিশ কেন দেহটির ময়না তদন্ত করল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গ্রামের একাংশ বাসিন্দা।এই বিষয়ে মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এদিন শুনেছি সাপের কামড়ে মৃত্যু হওয়া এক ব্যক্তির দেহ কবর থেকে তোলার চেষ্টা হয়েছিল। নিজেরাই দেহ তুলে নেন। ময়না তদন্তের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা ঘটনাটি খতিয়ে দেখছি।’’
এই গ্রামে সাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশের মতো। অধিকাংশই দিনমজুর পরিবার। রাস্তাঘাট বেশির ভাগই কাঁচা। মথুরাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান বলেন, ‘‘হাসপাতাল এখান থেকে খুব দূরে নয়। তবু মানুষ যে গুণিনের উপরে নির্ভর করছেন, তার কারণ অজ্ঞতা জনিত কুসংস্কার।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আগের তুলনায় এখন স্কুলে আসার প্রবণতা বেড়েছে। স্কুলছুটের সংখ্যাও কমছে। তাই আশা করি, নতুন প্রজন্ম ঘরে ঘরে অন্ধ বিশ্বাসের বিরোধিতা করবে। যতদিন তা না হচ্ছে, তত দিন কিন্তু সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’’
গত শুক্রবার রাতে মানিকচক থানার নাজিরপুরের হরিপুর গ্রামে মনসা গানের আসরে জ্যান্ত সাপ নিয়ে অভিনয় করার সময় ছোবলে মৃত্যু হয় মিঠুন মন্ডল নামে এক লোকশিল্পীর। তাঁর বাড়ি মানিকচকের মথুরাপুরের কামালপুর গ্রামে। তিনি বছর দশেক ধরে মনসা গানের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মনসা গান করার আগে তিনি সাপ ধরার কাজ করতেন। গান করার সময় সাপের কামড় খেলেও চিকিৎসা করাননি তিনি। ওই দিনই রাতে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। দিনভর তাঁকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে বাড়িতে ওঝা, গুণিনদের ডেকে ঝাড়ফুঁক করান পরিবারের লোকেরা। বাড়ির মনসা মন্দিরের সামনে দিনভর তাঁর দেহটি রেখে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা চালায় ওঝা, গুণিনেরা। পরে দুপুরের দিকে গ্রামের একাংশ বাসিন্দাদের কথায় মিঠুন মন্ডলকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিকচক গ্রামীণ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এরপর মৃতদেহটি গত শনিবার বিকেলে মানিকচকের উৎসব টোলা ঘাটে গঙ্গা নদীর ধারে কবর দেওয়া হয়। তবে পরিবার সহ আত্মীয় স্বজেনা মিঠুনবাবুর মৃত্যুর ঘটনাটি যেন কিছুতেই মানতে পারছেন না। পরিবার সূত্রে জানা যায়, মানিকচকের জোগিপুরের এক গুণিন বলে সাপের কামড়ে মৃত্যু রোগী সাত দিন পরেও বেঁচে যেতে পারে। তাই এদিন সকালে ওই গুণিনকে সঙ্গে নিয়ে মৃতের আত্মীয় স্বজেনেরা হাজির হন গঙ্গা নদীর ধারে। মাটি খুঁড়ে দেহও দেখেন তাঁরা। তবে দেহটিতে পচন ধরে যাওয়ায় ফের মাটি চাপা দিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাটিতে হইচই হতেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান ওই গুণিন।
মৃতের কাকা হরেন মন্ডল বলেন, ‘‘জোগিপুরের ওই ওঝা সকালে বাড়ি গিয়ে বলেন তিনি মিঠুনকে ভালো করতে পারবেন। তবে মৃতের নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হলে বাঁচাতে পারবেন না। তাই কবরে গিয়ে মুখ দেখা হয়েছিল। তবে রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় চেষ্টা করা হয়নি।’’
মৃতদেহটি ময়না তদন্ত না হওয়ায় বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে হাসপাতাল এবং পুলিশের ভুমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। হাসপাতাল থেকে কেন মৃতদেহটি ছেড়ে দেওয়া হল? যদিও মারা যাওয়ার পর চার ঘণ্টা ধরে দেহ আটকে রাখা হয় হাসপাতালে। মানিকচক গ্রামীণ হাসপাতালের আধিকারিক জয়দীপ মজুমদার বলেন, ‘‘জরুরি বিভাগে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল ওই রোগীটিকে। এরপরে পরিবারের লোকেরা নাম নথিভুক্ত করার আগেই দেহ নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাই দেহ রাখা সম্ভব হয়নি।’’
মানিকচক থানার পুলিশ জানিয়েছে, ‘‘ময়না তদন্তের জন্য পরিবারের লোকেদের বলা হয়েছিল, তবে তাঁরা রাজি হননি।’’ গ্রামগঞ্জে সচেতনার অভাবের জন্য ওঝা, গুণিনদের আজও রমরমা বলে মনে করছেন সাহিত্যিক তথা অধ্যাপিকা সুস্মিতা সোম। তিনি বলেন, ‘‘প্রশাসনের উচিত মানুষের মধ্যে থেকে কুসংস্কার দূর করা। প্রশাসনের পাশাপাশি আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আর মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।’’ মানিকচকের বিডিও উৎপল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এদিন আমরা গ্রামে গিয়েছিলাম। পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে খুব শীঘ্রই শিবির করা হবে।’’