মালদহের মানিকচকে এক ধর্ষিতার আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি জনস্বার্থের মামলা দায়ের করলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র। হাইকোর্টের নির্দেশে ঘটনার তদন্ত করতে শুক্রবার দুপুরেই বসন্তটোলা গ্রামে যান মালদহের ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বিভাস পট্টনায়ক। তিনি রিপোর্ট দেবেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। সোমবার মামলাটি ফের হাইকোর্টে ওঠার কথা।
বারবার ধর্ষণের পরে দুষ্কৃতীদের উৎপীড়নে গায়ে আগুন দিয়ে জ্বালা জুড়িয়েছিল মধ্যমগ্রামের কিশোরী। মানিকচকের ধর্ষিতা আত্মাহুতি দিয়েছেন সালিশি সভায় অপমানিত হওয়ার পরে। সুবিচার চেয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন মধ্যমগ্রামের কিশোরীর বাবা। আর মানিকচকের ঘটনায় মামলা ঠুকল হাইকোর্টই। এই মামলাটি বৃহত্তর মাত্রা পেয়েছে সালিশি সভার বিষয়টি যুক্ত থাকায়।
ধর্ষণে অভিযুক্ত এক কিশোরের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে চেয়েছিলেন মানিকচকের ভুতনির বসন্তটোলা গ্রামের ওই গৃহবধূ। গ্রামের সালিশি সভায় মাতব্বরেরা তাতে আপত্তি করেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল, অভিযুক্ত কিশোরকে কেবল অভিযোগকারিণীর পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তার পরে ২০ বার কান ধরে ওঠবোস করলেই হবে। ওই মহিলা তা মানতে পারেননি। তিনি পুলিশে অভিযোগ জানাতে অনড় ছিলেন। তখন মাতব্বরেরা ভরা সভার মধ্যেই তাঁকে ‘কুলটা’ বলে মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ। সেই অপবাদে বুধবার সকালে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ওই মহিলা। বৃহস্পতিবার ভোরে মালদহ মেডিক্যাল কলেজে তাঁর মৃত্যু হয়।
হাইকোর্ট ওই ঘটনা নিয়ে নিজে থেকে মামলা দায়ের করেছে, এ খবর মালদহে পৌঁছতে দেরি হয়নি। পুলিশি তদন্তে যাতে কোনও গাফিলতি না-হয়, তার তদারক করতে এসপি রাজেশ যাদবও পৌঁছে যান ওই গ্রামে। ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত নবীন মণ্ডলকে এখনও ধরা যায়নি। তবে পুলিশ তার মা রেখা মণ্ডল ও কাকা বিশ্বেশ্বর মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু যাঁরা সালিশি সভা ডেকেছিলেন, তাঁদের কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি।
হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে এ দিন ওই ঘটনার উল্লেখ করেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরের অংশবিশেষ প্রধান বিচারপতিকে দেখিয়ে বলেন, “এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। সালিশি সভা বসিয়ে যে-ভাবে এক গৃহবধূকে চরিত্রহীন বলে অপবাদ দেওয়া হল, তাতে ওই মহিলা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।” বিকাশবাবুর মন্তব্য, এটি নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রায় রোজই সালিশি সভার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হচ্ছে। বীরভূমের লাভপুরে সালিশি সভার নির্দেশ না-মানায় এক তরুণীকে গণধর্ষণের শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্য একটি ঘটনায় সালিশি সভা এক মহিলাকে বিবস্ত্র করে গ্রাম ঘোরানোর নির্দেশ দেয়।
বিকাশবাবু জানান, সালিশি সভার বিচার যাতে বন্ধ হয়, সেই জন্য তিনি জনস্বার্থের মামলা করতে চান। আদালত থাকতেও এমন গ্রাম্য বিচার ব্যবস্থা কী ভাবে চলতে পারে, প্রশ্ন তোলেন তিনি। তাঁর আবেদন, সালিশি সভার নামে সমান্তরাল আদালত চালানোর যে-চেষ্টা চলছে, তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কিছু মানুষ নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সালিশির আশ্রয় নিচ্ছে। হাইকোর্ট এর বিহিত করুক।
প্রধান বিচারপতি মিশ্র বলেন, “এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে জনস্বার্থের মামলা দায়ের করছে।” সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালানোর পরে এ ভাবেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জনস্বার্থের মামলা দায়ের করেন হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। সেই মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কোর্ট।
হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নির্দেশে মালদহের ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ এ দিনই বসন্তটোলা গ্রামে গিয়ে ধর্ষিতা বধূর স্বামী, ছেলে এবং পরিবারের অন্যদের সঙ্গে কথা বলেন।
মঙ্গলবার মন্টু মণ্ডল নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে সালিশি সভায় কী ঘটেছিল, সেই সভায় গ্রামের কারা ছিলেন, ধর্ষিতার পরিজনদের কাছ থেকে সব জেনে নেন তিনি। জেলা ও দায়রা জজ একাধিক গ্রামবাসীর সঙ্গে পৃথক পৃথক ভাবে কথা বলেছেন। গ্রামবাসীরা জেলা ও দায়রা জজ এবং এসপিকে জানান, সালিশি সভায় ২৫-৩০ জন হাজির ছিলেন। বিধায়ক তথা রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র বলেন, “সালিশি সভায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সকলেই অপরাধী। সকলকেই গ্রেফতার করতে হবে।”
সালিশি সভায় হাজির মাতব্বরদের ধরার জন্য পুলিশ তল্লাশি শুরু করায় গোটা গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। পুলিশ সুপার বলেন, “ধর্ষণ ও সালিশি সভার কথা পুলিশ জানত না। বিষয়টি জানা মাত্র পুলিশই প্রথমে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করেছে। পরে আত্মঘাতী বধূর শ্বশুরের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।” যাঁরা সালিশি সভা ডেকেছিলেন, তাঁদের কাউকে গ্রেফতার করা হল না কেন? এসপি বলেন, “আত্মঘাতী বধূর শ্বশুরের অভিযোগের ভিত্তিতে নবীন মণ্ডল, রেখা মণ্ডল, মনোরঞ্জন মণ্ডল ও অন্য অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে দু’জনকে।