এসেছিলাম, ফিরে যেতে হবে জানা ছিল না!
আবৃত্তির সিডি-র নামটা প্রথমেই চোখে পড়েছিল সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। তখনও ২০১১-র বিধানসভা ভোটের দেড়-দু’মাস বাকি। আবৃত্তিকার বিশ্বনাথ চৌধুরীকে ডেকে বুদ্ধবাবু অস্ফুটে প্রশ্ন করেন, “আচ্ছা, এই নামটা আপনার মাথায় এল কী ভেবে?”
সেই নাম কী করে ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে উঠল, এখনও ভেবে পান না বুদ্ধদেবের মন্ত্রিসভার সদস্য বিশ্বনাথবাবু। সে বার রাজ্যে বামেরা ধরাশায়ী হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর সাত বারের জেতা আসন বালুরঘাট বিধানসভায় ১৮ হাজারের মার্জিনে গো-হারান হারেন পোড়খাওয়া মন্ত্রী।
লোকসভা কেন্দ্র বালুরঘাট জয়ের যুদ্ধে বিশ্বনাথ নিজে প্রার্থী নন। তবে বাম প্রার্থী, আরএসপি-র বিমলেন্দু সরকারের প্রধান ভরসা তিনিই। কবিতার লাইনটা এখনও তাড়া করছে বিশ্বনাথকে। সিডি চালিয়ে স্বকণ্ঠে শুনছেন অমৃত মাইতির লেখা ছোট্ট চার লাইনের কবিতা।
এসেছিলাম, ফিরে যেতে হবে জানা ছিল না! / সারা জীবনে একটি গাছও লাগাতে পারিনি / এখন জ্বালানি খুঁজতে বেরিয়েছি / এসেছিলাম, ফিরে যেতে হবে জানা ছিল না!
এই তিন বছরে বালুরঘাটে ক্রমশ দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে থাকা বামেদের সঙ্গে কেমন মিলে যায় কবিতাটা। দক্ষিণ দিনাজপুরের তৃণমূল সভাপতি বিপ্লব মিত্র হিসেব দিচ্ছিলেন, গত পঞ্চায়েত ভোটের অঙ্কে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই কিন্তু পিছিয়ে বামেরা। আর বিধানসভা, পঞ্চায়েতের পরে জেলায় শাসক দলের সামনে এটা হ্যাটট্রিকের হাতছানি।
স্থানীয় ভোটমঞ্চে তৃণমূল প্রার্থী অর্পিতা ঘোষের ‘নির্দেশক’ কার্যত বিপ্লব। জনসভায় ঘুরে ঘুরে অর্পিতারও আবেদন, “আপনারা আমাদের এতগুলো বিধানসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত, সব ক’টা পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদে জিতিয়েছেন। বালুরঘাট পুরসভাতেও তৃণমূলকে আশীর্বাদ করেছেন। এখন শুধু শেষ কাজটা বাকি। আমাদের জেলাকে রাজ্যে এক নম্বর করতে দিল্লিতে আমাদের একটা লোক চাই। এটা দিতে হবে!”
প্রবীণ বিশ্বনাথ তবু উজান ঠেলে ঘুরে দাঁড়ানোর ছক কষছেন। তপন বিধানসভা এলাকার ঠাকুরপুরায় সভার ফাঁকে গাড়ির চালককে চুপিচুপি বলছেন মাথা গুনতে! আরএসপি-র জেলা সম্পাদক বিশ্বনাথের আশা, টেট কেলেঙ্কারি বা শাসক দলের কোনও কোনও বিধায়কের ঠাটবাটের চকিত বাড়বাড়ন্তে মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে। শুনে জেলায় তৃণমূলের ভোট-সেনাপতি বিপ্লব ঠোঁট উল্টোন অস্বস্তির জায়গাগুলো পঞ্চায়েত ভোটেই সামাল দেওয়া গিয়েছে!
তৃণমূলের কোনও কোনও নেতাই আবার একটা কথা ভাসিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী বিশ্বনাথ দাঁড়ালে তা-ও লড়াই হতো! শুনে তিনি দৃশ্যতই অস্বস্তিতে। “এ-সব কথা আবার কেন! আমি তো নিজেই শারীরিক কারণে দাঁড়াতে চাইনি। আর আমাদের প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ নেই।”
বামেদের পাল্টা খোঁচা, গোষ্ঠী কোন্দলে ভরপুর তৃণমূলের সর্ষের মধ্যে ভূত নিয়ে! বিপ্লবের ‘এমপি’ হওয়ার অতৃপ্ত বাসনাই নাকি অর্পিতার মোক্ষম ‘পথের কাঁটা’! জবাবে বিপ্লব সোজা ব্যাটেই খেলছেন। “আ-হা, আমি লড়লে এক লক্ষ ব্যবধান হতো! অর্পিতাও অন্তত ৬০ হাজারে জিতবেন! সেটাই বা মন্দ কী?”
বালুরঘাটের সাবেক বাসিন্দা, খেলাপাগল বিমলেন্দু বনাম নাট্যকর্মী অর্পিতার যুদ্ধকে প্রত্যাশিত ভাবেই ভূমিপুত্র ও বহিরাগতের টক্কর বলে দেগে দিতে চায় আরএসপি। বিশ্বনাথ মনে করাচ্ছেন, বিধানসভা ভোটে বহু বছর আগে যতীন চক্রবর্তীকেও কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছিল বালুরঘাট।
কংগ্রেসের অধ্যাপক-প্রার্থী, ওমপ্রকাশ মিশ্র বা বিজেপি-র রাজ্য নেতা বিশ্বপ্রিয় রায়চৌধুরীও নিজেদের ‘বালুরঘাট-কানেকশন’ প্রমাণ করতে মরিয়া। ওমপ্রকাশ বালুরঘাটের জামাই, বালুরঘাট কলেজের প্রাক্তনীও বটে। মালদহের বিশ্বপ্রিয় ফলাও করে হরিরামপুরে পারিবারিক বাড়ির কথা বলছেন। শহরের প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রার্থীদের সৌজন্য-সাক্ষাতের যেন প্রতিযোগিতা চলছে।
চতুমুর্খী লড়াইয়ে পাটিগণিতই কি তবে শেষ কথা বলবে? বামেদের আশা, দক্ষিণপন্থী ভোট ভাগাভাগিতে কপালে শিকে ছিঁড়তে পারে! সীমান্তবর্তী কেন্দ্র বালুরঘাটে বিজেপি-কে কখনওই ফেলনা বলা যায় না। তার উপরে এ হল মোদী-হাওয়ার বছর। আগে পদ্মকে ঠুকে নাটকীয় ভঙ্গিতে মঞ্চের সংলাপের প্যারডি আওড়াতেন বিশ্বনাথবাবু ‘পদ্ম তার ভাঙা সংসার নিয়ে কোথায় যাবে! বালুরঘাটের দেওয়াল ছাড়া আর কোথাও যে তার ঠাঁই হবে না।’
এ বার কী করছেন?
পালাবদলের পরে সল্টলেকে মন্ত্রীর বাড়ি থেকে পাততাড়ি গুটোনোর সময়েই তাঁর গান-কবিতার খাতাটা হারিয়েছে বলে আফসোস করলেন বিশ্বনাথবাবু। ‘জল থেকে ছিটকে আসা মাছ’ অর্পিতাকে বিঁধতে জুতসই সংলাপ হাতড়ে চলেছেন। পঞ্চায়েত ভোট ও বালুরঘাটের পুরভোটে প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে আওয়াজ তুলতেও কসুর করছেন না।
বিপ্লববাবুর হাসিটা তাতে চওড়াই হচ্ছে, “ওরা হারের আগে হেরে বসে আছে!” বলা বাহুল্য, অর্পিতা জিতলে গৌরবের ছটা তাঁর গায়েও লেপ্টে যাবে। হারলে, জেলা নেতাদের প্রার্থী না-করার খেসারতের তত্ত্বও এড়ানো যাবে না। ‘লোকাল গার্জেন’ বিপ্লবদা তাই খোশমেজাজে অর্পিতাকে আত্রেয়ী নদীর বিখ্যাত রায়কর মাছে আপ্যায়নের আয়োজন করছেন।
ভোটচক্রে দিদির প্রার্থীরও মন্ত্র, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy