Advertisement
১৮ মে ২০২৪

যুবক খুন ঘিরে শিলিগুড়িতে তাণ্ডব, অভিযুক্ত শাসক দলই

পুলিশের খাতায় নাম থাকা এক যুবকের খুন হওয়াকে ঘিরে সোমবার প্রায় দিনভর ধুন্ধুমার চলল শিলিগুড়ির সেবক রোডের বিস্তীর্ণ এলাকায়। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের নেতা-কর্মীরাই জড়িত ছিলেন ওই তুলকালামে। তাঁদের মদত দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেব।

ভক্তিনগর থানার সামনে জাতীয় সড়কে জ্বলছে অভিযুক্ত মনকুমারের সিন্ডিকেটের দফতর। চলছে অবরোধও। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

ভক্তিনগর থানার সামনে জাতীয় সড়কে জ্বলছে অভিযুক্ত মনকুমারের সিন্ডিকেটের দফতর। চলছে অবরোধও। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৩২
Share: Save:

পুলিশের খাতায় নাম থাকা এক যুবকের খুন হওয়াকে ঘিরে সোমবার প্রায় দিনভর ধুন্ধুমার চলল শিলিগুড়ির সেবক রোডের বিস্তীর্ণ এলাকায়। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের নেতা-কর্মীরাই জড়িত ছিলেন ওই তুলকালামে। তাঁদের মদত দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেব। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী বলেন, “যুবকটি আমাদের সক্রিয় কর্মী। ওঁকে খুনের ঘটনায় ছয় অভিযুক্তের মধ্যে তিন জন ধরা পড়েছে। কিন্তু মূল অভিযুক্ত সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য ফেরার। তাতে জনতার ক্ষোভ হতেই পারে।”

পুলিশ জানায়, ওই নিহত যুবকের নাম দীপঙ্কর রায় ওরফে ছোট্টু (২৭)। বাড়ি ভক্তিনগর থানা লাগোয়া সরকারপাড়ায়। এলাকায় তাঁর একাধিক ‘ম্যাসাজ পার্লার’ রয়েছে। ফটো-কপি, ফ্যাক্স পরিষেবার ব্যবসাও রয়েছে। এ দিন ভোরে তাঁর দেহ মেলে মহানন্দার চরে। দেহে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর চিহ্ন ছিল। হাতের আঙুল কেটে দেওয়া হয়েছিল। ওই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মনকুমার রাইকে গ্রেফতার করা যায়নি কেন এই প্রশ্ন তুলে এ দিন সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় গণ্ডগোল।

পুলিশ সূত্রের খবর, ভক্তিনগর থানায় ওসির ঘরে ঢুকে মনকুমার কেন ধরা পড়েনি সেই প্রশ্ন নিয়ে এ দিন সকালে গলা চড়ান এলাকার বেশ কিছু তৃণমূল নেতা। খোদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীও ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মনকুমারের পিছনে সিপিএমের মদত রয়েছে এই অভিযোগ করে, তাঁকে দ্রুত গ্রেফতার করা না হলে শাসক দল রাস্তায় নামবে বলে জানিয়ে দেন মন্ত্রী। এর পরে পুলিশের সামনেই মনকুমারের অফিস ও বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন লাগিুয়ে দেওয়া হয়। অন্তত ঘণ্টা তিনেক জাতীয় সড়কে অবরোধ করা হয়। বিকেলের দিকে দোকানপাট, অফিস জবরদস্তি বন্ধ করে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ।

মনকুমারকে মদত দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে শাসক দলের নেতা-কর্মীরা কেন রাস্তায় নেমে আইন ভাঙলেন, পাল্টা সে প্রশ্ন তুলেছেন সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার। তাঁর দাবি, “আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতে এমন করলেন শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। আর তাঁদের সেই তাণ্ডবে মদত দিয়েছেন মন্ত্রী গৌতম দেব।”

ছোট্টুকে খুনে প্রধান অভিযুক্ত মনকুমার রাই পুলিশের কাছে পরিচিত নাম। ভক্তিনগর থানার গেটের এক দম উল্টো দিকে জাতীয় সড়কের ধার দখল করে একটি অফিস খুলে তিনি সিকিম রুটের ছোট গাড়ির চালকদের ‘সিন্ডিকেট’ চালান বলে অভিযোগ। বাম-আমল থেকেই ওই ব্যবসা। গাড়ির ব্যবসার আড়ালে কাশির সিরাপ, মাদক পাচারের অভিযোগ রয়েছে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যদের একাংশের বিরুদ্ধে। মনকুমারের বিরুদ্ধে খুন, তোলা আদায়, অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। সিকিম থেকে ফুঁসলে আনা মেয়েদের সেবক রোডের ম্যাসাজ পার্লারে নিয়োগ করার অভিযোগও পুলিশ পেয়েছে। এহেন মনকুমারের সঙ্গে মাদক ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ছোট্টুকে খুন হতে হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের সন্দেহ।

তবে মন্ত্রীর দাবি, “ছোট্টু মাদকের কারবারের বিরোধী ছিলেন, বলেই ওঁকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।” ছোট্টুর দাদা দেবাশিস রায়েরও দাবি, “মাদক পাচারকারীদের ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল বলেই ভাইকে খুন হতে হল।” যদিও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ছোট্টুও রীতিমতো বিতর্কিত চরিত্র। ২০১২ সালে বিরল প্রজাতির তক্ষক (গেকো) পাচারের মামলায় ছোট্টুকে ধরেছিল ভক্তিনগর থানার পুলিশ। এলাকায় নানা সময়ে ‘দাদাগিরি’ করার অভিযোগও রয়েছে ওই যুবকের বিরুদ্ধে। মাসখানেক আগে শিলিগুড়িতে সিদ্ধার্থনাথ সিংহের উপস্থিতিতে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেই মঞ্চে সিদ্ধার্থনাথ সিংহের পাশেই দেখা গিয়েছিল তাঁকে। কিছু দিন পরে ওই যুবক ফের তৃণমূলে যোগ দেন।

এমন এক জনের খুনের তদন্ত চেয়ে তৃণমূল তুলকালাম বাধাল কেন? গৌতম দেব বলেন, “কারও নামে মামলা থাকলে তাঁকে কুপিয়ে খুন করাকে সিপিএম যুক্তিযুক্ত বলতে পারে। আমরা বলব না। আদালতে সাজা তো ওই যুবকের হয়নি।”

সিদ্ধার্থনাথ সিংহের সভায় দীপঙ্কর বিশ্বাস। —ফাইল চিত্র

তবে তৃণমূলের অন্দরের খবর, ভক্তিনগর এলাকায় বেআইনি কারবারে দলের অন্তত তিন জন নেতা যুক্ত বলে নানা সময়ে প্রদেশ তৃণমূলের অফিসে অভিযোগ পৌঁছেছে। সেই নেতাদের এক জনের ‘কাছের ছেলে’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ছোট্টু। তাঁর খুন নিয়ে অন্য দল হইচই করলে পুলিশ ও তৃণমূলের নেতাদের একাংশের যোগসাজশে কী ভাবে ভক্তিনগরে ‘সিন্ডিকেট’ ও ‘তোলাবাজি’ চলছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠত বলে আশঙ্কা ছিল দলের অন্দরে। সে জন্যই তড়িঘড়ি কয়েকজন তৃণমূল নেতা সাতসকালে পরিস্থিতির রাশ হাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন।

পুলিশ সূত্রের দাবি, সম্প্রতি মাদকের কারবার নিয়ে ছোট্টুর সঙ্গে মনকুমারের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। তা নিয়ে গোলমাল মেটাতে রবিবার সন্ধ্যায় ছোট্টুকে মনকুমারের লোকজন ডেকে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। রাতে ভক্তিনগর থানায় ছোট্টুর পরিবার অপহরণের অভিযোগ করে। পুলিশ ছোট্টুর হদিস পায়নি। তবে অপহরণে জড়িত সন্দেহে মনকুমারের এক ভাই-সহ তিন জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে ভোজালি মেলে বলে পুলিশের দাবি। পরে ভোরবেলা ছোট্টুর দেহ মেলে। সকাল থেকে এত কাণ্ড যেখানে ঘটেছে, সেখান থেকে দু’কিলোমিটার দূরেই পুলিশ কমিশনারের অফিস। পুলিশ কমিশনার জগমোহন দুপুরে ঘটনাস্থলে যান। তার পরেও ওই এলাকায় শাসক দলের নেতা-কর্মীদের একাংশ জবরদস্তি দোকানপাট বন্ধ করান বলে অভিযোগ কিছু ব্যবসায়ীর। পুলিশ কমিশনার বলেন, “তদন্ত হচ্ছে। খুনের পরে পরিস্থিতি কেন অগ্নিগর্ভ হল তা-ও খতিয়ে দেখা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE