নজির তৈরি করল সিতাই।
কোচবিহারের প্রত্যন্ত এই ব্লকে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের উদ্যোগে তৈরি হল জেলার প্রথম বহুমুখী হিমঘর। প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে, তিন একর জমির উপর গড়ে ওঠা হিমঘরের মালিকানা ৪২৬টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর। সব্জিচাষিদের হিমঘর ভাড়া দিয়ে ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করার পর যা লাভ থাকবে, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে গোষ্ঠীগুলি। তারাই হিমঘরের শেয়ার-মালিক।
সিতাইয়ের গাড়ানাটায় শুক্রবার বিকেলে ওই বহুমুখী হিমঘরটির উদ্বোধন করেন পূর্ত দফতরের পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের উদ্যোগ, মনের জোর দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “কোচবিহার কেন, গোটা রাজ্যের কোথাও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা হিমঘর তৈরি করেছে বলে শুনিনি।” উদ্যানপালন দফতরের তরফে সব্জি পরিবহণের জন্য একটি বাতানুকূল গাড়ি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফল, সব্জি শিলিগুড়ি অবধি নিয়ে যাওয়ার জন্য চাষিদের ভাড়া দেওয়া হবে এই গাড়ি।
কেন সব্জির হিমঘর তৈরি করতে উদ্যোগী হলেন মেয়েরা? আদাবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে তৈরি ‘ক্লাস্টার’-এর দায়িত্বে রয়েছেন লতিকা বর্মন। জানান, এখানে তামাকের চাষ হত। তা লাভজনক না থাকায় চাষিরা ঝুঁকছেন সব্জির দিকে। কিন্তু সমস্যা সংরক্ষণের। কোচবিহারে ১০টা হিমঘর থাকলেও, সেগুলো আলুর জন্যই ব্যবহার হয়। “শীতের সময়ে দাম না পেয়ে টোম্যাটো, বাঁধাকপি, কাঁচালঙ্কা বাজারে ফেলে রেখে চলে যান চাষিরা। তাই সবাই মিলে বহুমুখী হিমঘর তৈরি করেছি,” বলেন লতিকা দেবী।
লড়াইটা শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের গোড়ায়। তিলে তিলে টাকা সংগ্রহ করতে শুরু করেন সুনীতি বর্মন, লতিকা বর্মন, আয়েষা খাতুনের মতো স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরা। ওই এলাকায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ফেডারেশন তৈরি হয়নি। তাই তৎকালীন বিডিও অশ্বিনী রায়ের পরামর্শে ২০০৮-এ মেয়েরা “সিতাই নিরক্ষরতা ও দারিদ্র দূরীকরণ সমিতি” গড়ে তোলেন। তার সদস্য হয় ৪২৬টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী, যাদের সদস্য প্রায় পাঁচ হাজার মহিলা। নিজেদের সঞ্চয় থেকে ৪৯ লক্ষ টাকা হিমঘরের জন্য দেয় গোষ্ঠীগুলি। উত্তরবঙ্গ ক্ষেত্রীয় গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, নাবার্ড-সহ বিভিন্ন সংস্থা মিলিয়ে ঋণ ও অনুদান হিসেবে আরও ৩ কোটি ৭ লক্ষ টাকা মেলে। তিন একর জমি কিনে হিমঘর তৈরি হয়।
বর্তমানে হিমঘরে চারটি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে চার হাজার মেট্রিক টন সব্জি সংরক্ষণ করা যাবে। এ ছাড়া হিমঘরে রাখা হবে আপেল, আম, কুল, আনারস, কলার মতো ফল, আর সেই সঙ্গে ছানা। “আলু রাখার জন্য চাপ রয়েছে স্থানীয় চাষিদের,” বললেন সমিতির সম্পাদক উপেন বর্মন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। “যদি সব্জি রেখে চেম্বার ফাঁকা থাকে, আলুও রাখা হবে। টাকা তুলতে হবে তো।” কেবল বিদ্যুতের জন্যই বছরে ৫০-৬০ লক্ষ টাকা খরচ হবে, বলেন উপেনবাবু। এ বাবদ কোনও ভর্তুকি মিলছে না তাঁদের।
কোচবিহারে শীতের সময়ে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সব্জি চাষ হয়। অন্য সময়ে আরও ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সব্জি চাষ হয়। তা হলে এতদিন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কেন? উদ্যানপালন দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “আসলে বহুমুখী হিমঘরে খরচ বেশি। তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন। সে জন্যই ব্যবসায়ীদের উৎসাহ কম।”
নিজেদের কষ্টের সঞ্চয় লগ্নি করে, ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে সেই ঝুঁকিই কাঁধে নিলেন সিতাইয়ের গরিব মেয়েরা। আয়েষা খাতুন, লুতফা বিবি, তৃপ্তি সন্ন্যাসী, পম্পা বর্মনেরা বলেন, “লড়াই যখন শুরু করেছি, তখন হাল ছাড়ার প্রশ্ন নেই। হিমঘরকে লাভের মুখ দেখাবই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy