শঙ্করপুর সমুদ্র সৈকতে এ ভাবেই পড়ে থাকে মৃত কচ্ছপ। ছবি: সোহম গুহ।
আধুনিক নগরোন্নয়ন আর অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়েই আহ্লাদিত সরকার ও প্রশাসন। সমুদ্রতটের ভাঙন রোধ করতে প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে কংক্রিটের বাঁধ। সঙ্গে তো রয়েছেই আগাছার মতো গজিয়ে ওঠা হোটেল ব্যবসা। সৌন্দর্যায়নের নামে সৈকতকে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন আলোয়। দিঘা, শঙ্করপুর, তাজপুর বা মন্দারমণি— সর্বত্রই ছবিটা একই।
আধুনিকতার ধাক্কায় ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র। বিপন্ন বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক জীব। তার মধ্যে অন্যতম অলিভ রিডলে। হেলদোল কোনও তরফে। বন দফতর বা প্রশাসনের কর্তারা কেউ জানেনই না ২৩ মে চলে গেল বিশ্ব কচ্ছপ দিবস।
অবশ্য জেনেও তেমন লাভ হত কি? সে প্রশ্ন কোটি টাকার। এমনিতেও কোথাও কোনও রকম সচেতনতা মূলক প্রচার হয় না। এই বিশেষ দিনেও দেখা যায়নি কোনও অনুষ্ঠান কি আলোচনা সভা।
সমীক্ষা বলছে এক সময় প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলে দল বেঁধে আসত অলিভ রিডলে প্রজাতির কচ্ছপ। মূলত সঙ্গম ও ডিম পাড়ার সময়টি এরা দিঘা, শঙ্করপুর, মন্দারমণির উপকূলে কাটিয়ে যেত। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে অলিভ রিডলের সংখ্যা কমে গিয়েছে। গতিপথ বদলে এখন তারা প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার ঋষিকূল্য, গহিরমাথা উপকূলের দিকে চলে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ১৫ থেকে ১৭ এপ্রিল অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র ও অলিভ রিডলে নিয়ে এক কর্মশালার আয়োজন করে বন মন্ত্রক এবং ইউনাইটেড নেশন ডেভলপমেন্ট প্রোজেক্ট। সেখানে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পুণ্যশ্লোক ভাদুড়ি তাঁর সমীক্ষাপত্র থেকে জানান, অলিভ রিডলে প্রজাতির এই গন্তব্য পরিবর্তনের অন্যতম কারণ পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল জুড়ে সুসংহত উপকূল তটাঞ্চল (আইসিজেডএম) গড়ে তোলার নামে অপরিকল্পিত নগরায়ন। সেই সঙ্গে অবশ্য তিনি আঙুল তোলেন যথেচ্ছ শিকার প্রবণতার দিকেই।
বাস্তব চিত্রটাও মূলত সে দিকেই ইঙ্গিত করে। বাঁধান পাড়, ক্রমাগত জন সমাগম, উজ্জ্বল আলোয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না অলিভ রিডলে। তাই এখন আর তারা আসে না মেদিনীপুরের উপকূলে।
পাশাপাশি কাঁথি মহকুমার জুনপুট, শৌলা, দাদনপাত্রবাড়, শঙ্করপুর, চেঁওয়াশুলি, নিউজলধা, মন্দারমণি ও আশেপাশের সৈকত এলাকায় একশ্রেণির মানুষ সামুদ্রিক কচ্ছপ শিকার ও পাচারের সঙ্গে যুক্ত। খোলা বাজারে কচ্ছপের মাংসও বিক্রি হয় নিয়মিত। সমুদ্র সৈকতে একটু ঘোরাফেরা করলেই চোখে পড়বে বালির মধ্যে মৃত কচ্ছপের দেহাবশেষ বা খোলস। কাঁথি, মারিশদা, খেজুরি, ভগগবানপুর, এগরা ও ভূপতিনগর, পটাশপুরের বিভিন্ন গ্রামীণ হাটগুলিতে সামুদ্রিক কচ্ছপের মাংস বিক্রি হয় দেদার।
অনেক সময়ই মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার জালে আটকে পড়ে কচ্ছপ। কিন্তু সামান্য কিছু টাকার লোভে সেই কচ্ছপ আর সমুদ্রে ফিরিয়ে দেন না মৎস্যজীবী। তা ছাড়া কাঁথি মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েই বেআইনিভাবে কচ্ছপ শিকার, পাচার ও মাংস বিক্রির কারবার তো চলছেই।
গত বছর ২৩ ডিসেম্বর কাঁথির দেশপ্রাণ ব্লকের আমতলিয়াতে কচ্ছপের মাংস বিক্রির খবর পেয়ে পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করে। উদ্ধার হয় ১৫টি বিরল প্রজতির সামুদ্রিক কচ্ছপ। ওই দিনই খেজুরির হেঁড়িয়াতে একটি লরি আটক করে উদ্ধার করা হয় ২৬টি সামুদ্রিক কচ্ছপ। গ্রেফতার হয় তিন পাচারকারী। উদ্ধার হওয়া ৪১টি কচ্ছপের মধ্যে ৩৫টিকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ছ’টিকে বাঁচানো যায়নি।
এ সবের কারণ হিসাবে মৎস্যজীবীরা কিন্তু দায়ী করছেন সচেতনতার অভাবকেই। নিউ জলধা মৎস্যখটির অশ্বিনী বর, আখতার হোসেনদের দাবি, তাঁদের জালে কচ্ছপ ধরা পড়লে তাঁরা ফের জলে ছেড়ে দেন। যদিও এ কথাও তাঁরা স্বীকার করেছেন, একশ্রেণির মৎস্যজীবী বাড়তি মুনাফার লোভে সে কচ্ছপ বিক্রি করে দেন বাজারে।
তবে রয়েছে অন্য অভিযোগও। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বেশকিছু মৎস্যজীবী বলেন, “রামনগর ২ ব্লকের চেওয়াশুলি থেকে মন্দারমণি পর্যন্ত প্রায় শ’খানেক হাইব্রিড মাগুর মাছের ভেড়ি রয়েছে। মাগুরের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য ভেড়ি মালিকরা সামুদ্রিক কচ্ছপের মাংস ব্যবহার করে মাছের খাদ্য হিসাবে। ফলে নিয়মিত কচ্ছপ শিকারের একটা শৃঙ্খল তৈরি হয়েই যায়।’’
কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী সমিতির সম্পাদক লক্ষ্মীনারায়ণ জানা অভিযোগ করেন, “একশ্রেণির বনকর্মীদের প্রচ্ছন্ন মদতেই চোরা শিকারিরা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। মৎস্যজীবীদের পক্ষ থেকেই বরং বেশ কয়েকবার বন দফতরকে ওয়াকিবহাল করা হয়েছে। কিন্তু বন দফতরের কোন উদ্যোগ নেই।’’ নেই সচেতনতা মূলক প্রচারও।
তবে কাঁথির রেঞ্জার ছত্রধর সরেনের দাবি, মহকুমার উপকূলীয় সৈকতে বন দফতরের পক্ষ থেকে নিয়মিত প্রচার চালানো হয়। এমনকী নিয়মিত অভিযান চালান বনকর্মীরা। তবে ছত্রধরবাবুর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, ‘‘২৩ মে-র কথা জানতাম না। উপর মহল থেকেও তেমন কোনও নির্দেশ ছিল না।’’ মন্দারমণির স্থানীয় গ্রামপঞ্চায়েত সদস্য নকুল হাজরা আবার দাবি করেন, স্থানীয় মৎস্যজীবীরাই নিজেদের উদ্যোগে সচেতন করেন পর্যটক এবং অন্যদের। তাঁর কথায়, ‘‘মৎস্যজীবী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে সৈকতের একটা অংশ ঘিরে দেওয়া হয়েছে। যাতে সমুদ্র পাড়ে এসে পড়া কচ্ছপদের কেউ বিরক্ত করতে না-পারে।’’ তবে তিনি স্বীকার করেন এত কিছু করেও বাঁচানো যাচ্ছে না বিরল কচ্ছপকে। লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর কথায়, “চোরা শিকারিরা রাতের অন্ধকারে কচ্ছপ ধরে পুকুরে লুকিয়ে রাখে। পরে সুবিধা মতো বিক্রি করে দেয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy