Advertisement
E-Paper

ভূতের গন্ধে দক্ষ অফিসার নবান্ন ছাড়া

তিনি বড়ই ভূত-কাতুরে! তিনি কর্মিবর্গে ভূত দেখেন, অফিসারে ভূত দেখেন, এমনকী ভূত দেখেন তাঁদের লেখা সরকারি নোটেও! আর দেখেন বলেই নবান্নের শীর্ষ আমলাদের রেটিংয়ে ‘অতীব দক্ষ’ কাজের লোক হওয়া সত্ত্বেও নিজের হাতে থাকা স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রিন্সিপাল সচিব (সমন্বয়)-কে বদলি করে দিতে কসুর করেন না। শুধু বদলিতেই শেষ নয়, প্রস্তাব দেন এখনই কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠানো হোক ওই অফিসারকে। প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা হই হই করে ওঠায় কোনও ক্রমে তা আটকে গেলেও নবান্নে আর ঠাঁই হয়নি ওই আইপিএস পি নীরজনয়নের।

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৯

তিনি বড়ই ভূত-কাতুরে!

তিনি কর্মিবর্গে ভূত দেখেন, অফিসারে ভূত দেখেন, এমনকী ভূত দেখেন তাঁদের লেখা সরকারি নোটেও!

আর দেখেন বলেই নবান্নের শীর্ষ আমলাদের রেটিংয়ে ‘অতীব দক্ষ’ কাজের লোক হওয়া সত্ত্বেও নিজের হাতে থাকা স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রিন্সিপাল সচিব (সমন্বয়)-কে বদলি করে দিতে কসুর করেন না। শুধু বদলিতেই শেষ নয়, প্রস্তাব দেন এখনই কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠানো হোক ওই অফিসারকে। প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা হই হই করে ওঠায় কোনও ক্রমে তা আটকে গেলেও নবান্নে আর ঠাঁই হয়নি ওই আইপিএস পি নীরজনয়নের। নবান্নের খবর, শনিবার পুলিশ এসটাব্লিশমেন্ট বোর্ড (পিইবি) যে সুপারিশটি করেছে, তার কোনও নড়চড় না হলে রাজ্য পুলিশের এডিজি (প্রশাসন)-এর দায়িত্ব নিয়ে আজ, সোমবার থেকে নীরজনয়ন বসবেন ভবানী ভবনে।

তিনি ভূত দেখেন!

আর দেখেন বলেই ওই পুলিশকর্তার কাজে ‘আনুগত্যের’ বহু ফাঁকফোকর খুঁজে পেয়েছে তাঁর দফতর। কী রকম? প্রশাসনের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাবে নবান্নের শীর্ষতলার (মুখ্যমন্ত্রীর অফিস এখানে) কিছু অফিসার জেনেছেন, নীরজনয়নের সঙ্গে সিবিআই এবং জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র কিছু অফিসারের হৃদ্যতা রয়েছে। সারদা কেলেঙ্কারি ও খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে রাজ্য সরকার যখন বেকায়দায়, তখন দুই কেন্দ্রীয় সংস্থার অফিসারেরা নবান্নে ঢুকে নীরজনয়নের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। হোক না সৌজন্য-সাক্ষাৎ, এতেই নীরজনয়নের বিশ্বাসভঙ্গের নমুনা খুঁজে পেয়েছেন ১৪ তলার অফিসারেরা। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলে কি এ ভাবেই নবান্নের ভিতরের খবর বাইরে যাচ্ছে?

তিনি সত্যিই ভূত দেখেন!

আর দেখেন বলেই ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও আতসকাঁচের নীচে ফেলতে চায় তাঁর অফিস। সেই সূত্রেই সরকারি কর্মী-অফিসারদের উপরে নজরদারিও যাচাই হয় অনবরত। নবান্নের অফিসারেরা বলছিলেন, “বাতাস ভারী অবিশ্বাসে। মোবাইলেও কথা বলা যায় না। দেওয়ালের যে কান রয়েছে, এত দিনে বুঝলাম!” তবে মোবাইলে কথা না বলে কি রেহাই আছে? এক অফিসার জানান, “কার ঘরে কে যাচ্ছে, কড়া নজর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (এসবি)। দিনে তিন-চারটি রিপোর্ট জমা পড়ে লালবাজারে।” তাতেও ক্ষান্তি নেই! নবান্ন মুড়ে ফেলা হয়েছে তিরিশেরও বেশি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায়। নজরের আড়াল থেকে নজরদারি।

তিনি ভূতের ভয়ে কাঁপেন!

আর কাঁপেন বলেই প্রশ্ন ওঠে, পুরনো সহকর্মী বা ব্যাচমেটের সঙ্গে দেখা করাটাও কি অপরাধ? শীর্ষমহলের একাংশ বলছেন, ডেপুটেশনে কাজ করার সুবাদে দিল্লির অফিসারদের সঙ্গে রাজ্যের অফিসারদের সখ্য গড়ে ওঠে। দিল্লি থেকে অফিসারেরা কলকাতায় এলে পুরনো সহকর্মীর খোঁজ করেন। কখনও দেখা হয়, গল্পগুজব হয়, কখনও হয় না। এই সৌজন্য যে দস্তুর, তা মানছেন আমলারা। তাঁদের কথায়, নীরজনয়ন আট-আটটা বছর সিবিআইয়ে ছিলেন। এনআইএ গঠনের পরে সিবিআই থেকে অনেকে সেখানে চলে যান। ফলে চাকরির সুবাদেই ওই দুই কেন্দ্রীয় সংস্থার একাধিক অফিসারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা আছে। তার মানেই দেওয়ানেওয়া চলছে? প্রশ্ন নবান্নের একাংশের।

তিনি সবেতেই ভূত দেখেন!

আর দেখেন বলেই অফিসারদের নোটেও অবিশ্বাসের ছায়া খোঁজে তাঁর অফিস। প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন কমিশনের তরফে যখন সারদা-র সম্পত্তি বেচে আমানতকারীদের বকেয়া মেটানোর কথা চলছিল, নীরজনয়ন আপত্তি তুলেছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তাদের তিনি বলেছিলেন, কোম্পানি আইন অনুযায়ী সংস্থার গড়ে ওঠা সম্পত্তি এ ভাবে বিক্রি করা যায় না। তার নির্দিষ্ট নিয়মবিধি আছে। ওই বক্তব্যেই পরে সিলমোহর দিতে হয়েছিল নবান্নকে। একই ভাবে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের স্ত্রীর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রশ্ন তুলেছিলেন নীরজনয়ন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সরকারি অনুদান দেওয়াটা দোষের নয়। তদন্তে যদি অর্থ নয়ছয়ের প্রমাণ মেলে, তা হলেই সেই সংস্থার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যেতে পারে। এর পরে এই বিষয়টিও ধামাচাপা পড়ে যায়।

তিনি ভূতের গন্ধে কাবু!

সে জন্যই সিবিআইয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হার চিঠিতে ‘অসাধু গাঁটছড়া’র গন্ধ পান তাঁর দফতরের অফিসাররেরা। নবান্নের শীর্ষকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, সিবিআইয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা গত বছর দু-দু’টো চিঠি লিখে নীরজনয়নকে সিবিআইয়ে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে। রাজ্য সে চিঠির জবাব না-দিলেও এই পত্র-বৃত্তান্ত পৌঁছে গিয়েছিল নবান্নের ১৪ তলায়। রাজ্য প্রশাসনের অনেকেই জানেন, কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকার সময় ‘তাঁর’ সঙ্গে সিবিআইয়ের প্রাক্তন অধিকর্তার সম্পর্ক ভাল ছিল না। সেই অতীতচারিতা থেকেই কি রঞ্জিত সিন্হার ‘পছন্দের লোক’ নীরজনয়নকে অপছন্দ? উঠছে সে প্রশ্নও।

তাঁর ভূত-ভূত বাতিক!

সে জন্যই ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে নবান্নে। প্রশাসনের একাংশের বদ্ধমূল ধারণা নীরজনয়নকে পুলিশ বিভাগে ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসারদেরও বার্তা দিয়ে রাখলেন ‘তিনি’। নবান্নের খবর, নীরজের কাজের প্রশংসা করে বদলি ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন ঊর্ধ্বতন অফিসারেরা। কিন্তু প্রশাসনে দক্ষতা কোনও মাপকাঠি নয়, তাঁর কথাই যে শেষ কথা (আলিপুর আদালতে হাজিরার সময় পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁর কথাই শেষ কথা), আরও এক বার বোঝালেন আধিকারিকদের।

তাঁর ভূতে ভারী ডর!

আর সেই জন্যই গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় ৩০০ ডব্লিউবিসিএস অফিসার বদলি হয়েছেন। বদলি হওয়া আইএএসের সংখ্যাও ডজন দুয়েক! বাম আমলে যেখানে অফিসারদের কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে (পদ নেই, কাজও নেই) পাঠানোর ঘটনা ক্বচিৎ কদাচিৎ শোনা যেত, এই জমানায় সেই উদাহরণ ভূরিভূরি।

তিনি ভূত-কাতুরে! খুবই!

debojit bhattacharya nabanna ghost
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy