Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শব্দের তাণ্ডব, হৃদরোগে বৃদ্ধের মৃত্যু ঝাড়গ্রামে

কালীপুজোর রাতে শব্দবাজিতে লাগাম টেনেছিল পুলিশ, তবে তা যে নিছকই ফস্কা গেরো, বুধবার বিকেল থেকে ঝাড়গ্রাম শহর জুড়ে পুলিশের ঢিলেঢালা চেহারায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তা।

শোকার্ত ছেলে-মেয়ে। ইনসেটে দুর্লভচন্দ্র মাহাতো। — নিজস্ব চিত্র।

শোকার্ত ছেলে-মেয়ে। ইনসেটে দুর্লভচন্দ্র মাহাতো। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:০৩
Share: Save:

কালীপুজোর রাতে শব্দবাজিতে লাগাম টেনেছিল পুলিশ, তবে তা যে নিছকই ফস্কা গেরো, বুধবার বিকেল থেকে ঝাড়গ্রাম শহর জুড়ে পুলিশের ঢিলেঢালা চেহারায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তা।

আমূল বদলে যাওয়া দীপাবলির সাঁঝে তাই শব্দের অনুশাসন না মেনে দেদার ফাটল শব্দবাজি। আর, এই তাণ্ডবের আবহে, বারবার নিষেধ সত্ত্বেও এক অসুস্থ বৃদ্ধের বাড়ির সামনে ক্রমাগত চকোলেট বোম ফাটানোয় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন তিনি— এমনই অভিযোগ তাঁর বাড়ির লোকের।

জেলা পুলিশ কর্তারা অবশ্য দীপাবলির রাতে শব্দ-দানবের দৌরাত্ম্যের প্রশ্নে তেমন আমল দিচ্ছেন না। এমনকী ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, ঘটনার সময়ে তাঁকে অভিযোগ জানানো হল না কেন? বলছেন, ‘‘ওই বৃদ্ধের সত্‌কারের পরে স্থানীয় কাউন্সিলর এসে থানায় অভিযোগ করেছেন ঠিকই অথচ, বুধবার রাতে যখন শব্দবাজি ফাটানো হচ্ছিল তখন কেউ পুলিশে খবর পর্যন্ত দিলেন না, এটাই আশ্চর্যের।”

ঝাড়গ্রাম শহরের মধুবন মোড় এলাকায় বাড়ি দুর্লভচন্দ্র মাহাতোর (৬২)। ওই দিন সন্ধ্যা থেকে বেপাড়ার জনা কয়েক যুবক এসে তাঁর বাড়ির সামনে তুমুল শব্দে চকোলেট বোম ফাটাতে থাকে বলে দুর্লভবাবুর পরিবারের অভিষোগ।

তাঁর ছোট ছেলে জগন্নাথ জানান, বিকেল ফুরোতেই শব্দ দানবের উৎপাত শুরু হয়েছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তার মাত্রাও। জগন্নাথ বলেন, ‘‘বাড়ির সামনে ওই যুবকদের বাজি ফাটাতে বারণ করায় ফল হল উল্টো। ওদের কয়েক জন বাড়িতে ঢুকে বাজি ফাটাতে থাকল। বাবা ভয়ে বুকে হাত দিয়ে সিঁটিয়ে বিছানায় বসে ছিলেন। প্রবল শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।” জগন্নাথবাবুর চিত্‌কারে পড়শিরা আসেন ঠিকই তবে, তাঁদের নাকের ডগায়তাণ্ডব চালায় ওই যুবকেরা। পরিজনেরা জানান, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ দুর্লভবাবুকে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আধ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান তিনি।

হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ওই রোগীকে খুবই সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকলে আচমকা বিকট আওয়াজে বিপত্তি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রেও সম্ভবত সে কারণেই মারা গিয়েছেন ওই বৃদ্ধ।’’

কয়েক ঘণ্টা ধরে শব্দবাজির তাণ্ডব চললেও দুর্লভবাবুর পড়শিরা ওই যুবকদের ঘাঁটাতে সাহস পাননি। তাঁরা কবুল করছেন, ওই যুবকদের দাপটে এমনিতেই ‘সিঁটিয়ে’ থাকেন তাঁরা। পাড়ার মোড়ে একটি চায়ের দোকানে সকাল থেকেই তাদের নিত্য বেলেল্লাপনার আসর বসে। অভিযোগ ওই দিন রীতিমতো মদ্যপ অবস্থায় তারা ফাটিয়ে চলেছিল শব্দবাজি। ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুকুমার শীট বলেন, ‘‘ওই ছেলেগুলোর নামে আগেও অভিযোগ হয়েছে। পুলিশ গা করেনি। এ বার কী করে দেখি!’’

শব্দবাজির বলি অবশ্য এ রাজ্যে নতুন নয়। ১৯৯৭ থেকে ২০১৩— ষোলো বছরে মারা গিয়েছেন ৮ জন। দুর্লভবাবু সেই তালিকায় শেষ সংযোজন। এত দিন ৯০ ডেসিবল-এ বাঁধা থাকত শব্দ-মাত্রা। ১৯৯৭ সালে, শব্দবাজির উপরে এই বেড়ি পড়িয়ে ছিলেন যিনি, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তদানীন্তন সেই আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ৯০ ডেসিবল এবং তা পরিমাপ করা হবে ৫ মিটার দূর থেকে— এই ছিল নিয়ম। এখন তা ১২৫ ডেসিবল করা হলেও নিয়মানুযায়ি শব্দের পরিমাপ কিন্তু করার কথা ৪ মিটার দূরত্ব থেকে।’’ কিন্তু সেই শব্দ-মাত্রা মানছে কে?

জগন্নাথ বলছেন, ‘‘তা মানলে কি এই অসময়ে বাবাকে চলে যেতে হয়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE