দক্ষিণ কলকাতার সরকারি আইন কলেজের ভিতরে ছাত্রীকে ‘গণধর্ষণে’র ঘটনায় শনিবারও প্রতিবাদের সুর বজায় রাখল বিরোধীরা। রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না-হলেও, ছাত্র সংসদের ঘর কী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারেরা। ওই ঘটনায় রাজ্যে চার জনের তথ্যানুসন্ধানী দল পাঠাচ্ছে বিজেপি। পক্ষান্তরে, তৃণমূল কংগ্রেস দোষীদের কড়া শাস্তির দাবি বজায় রেখেই বিরোধীদের পাল্টা নিশানা করেছে। তবে এরই মধ্যে দলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিধায়ক মদন মিত্রের মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় তার নিন্দাও করেছে তৃণমূল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিবেশ নিয়ে তৃণমূলকে নিশানা করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। তাঁর বক্তব্য, “তৃণমূলের গুন্ডা, তোলাবাজ ও ধর্ষণকারীরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করছে। আখড়ায় পরিণত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি। অধিকাংশ কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি ভাইপো গ্যাংয়ের লোকজন।” ঘটনার প্রতিবাদে এ দিন গড়িয়াহাট থেকে কসবা থানা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছিল রাজ্য বিজেপির যুব মোর্চা। মিছিল শুরুর আগেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার-সহ ৬৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সুকান্ত বলেন, “হাজার বার গ্রেফতার হব। কিন্তু বাংলার মেয়েদের ধর্ষণ বন্ধ হওয়া চাই।”
গণধর্ষণের ঘটনার তথ্যানুসন্ধানে প্রাক্তন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৎপাল সিংহ, মীনাক্ষী লেখি, লোকসভার সাংসদ বিপ্লব দেব, রাজ্যসভার সাংসদ মননকুমার মিশ্রকে নিয়ে এ দিনই চার জনের কমিটি গড়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি। সন্দেশখালি, আর জি কর, কালীগঞ্জের পরে এ বার দক্ষিণ কলকাতা— পর পর বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়েছেন বিজেপির অন্যতম জাতীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র।
পাল্টা সরব হয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্বও। রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “দোষীদের চরমতম শাস্তি চাই। মহিলাদের সম্মান নষ্ট হলে মুখ্যমন্ত্রী দোষীকে আড়াল করার চেষ্টা করেন না। তাই অপরাজিতা আইন করেছেন তিনি। তা কার্যকর করতে কেন অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না?”
কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কংগ্রেস, সিপিএম-সহ বিভিন্ন বিরোধী দলের পথের প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। মৌলালি মোড়ে অবরোধের পাশাপাশি, ডিসি নর্থের দফতর এবং কসবা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছে কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর বলেছেন, “দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। তার পরেও, ছাত্র-সংসদের ঘর কেন খোলা থাকে? সেখানে কারা, কী কাজ করতে বসেন?” সিপিএমের ডাকে পাটুলি থানা ঘেরাও এবং বামফ্রন্টের ডাকে বিজন সেতু থেকে কসবা থানা পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। নদিয়ার কালীগঞ্জ থেকে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও বলেছেন, “মমতা, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে কলেজ পরিচালনা করার দায়িত্ব দিয়েছে, সে-ই ধর্ষণ করল। ছাত্রনেতা ও কর্মচারী, সে আইনজীবী। পিসি-ভাইপো এই ভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছে বলেই অসংখ্য গাওয়াল শেখ (তামান্না খাতুন খুনে ধৃত তৃণমূলের বুথ সভাপতি) জন্মাচ্ছে পাড়ায়-পাড়ায়।”
ক্ষিণ কলকাতা ল’ কলেজের সামনে ছাত্র পরিষদের ধর্না-বিক্ষোভ। —নিজস্ব চিত্র।
বিরোধীদের নিশানা করে সরব হয়েছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, “যা ঘটেছে, সেই বিষয়ে তৃণমূল ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছে।” বিজেপির তথ্যানুসন্ধানী দলকে নিশানা করে কুণালের সংযোজন, “ওঁরা রাজনৈতিক পর্যটক? কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে যে মহিলা অভিযোগ করেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলা উচিত ওঁদের।”
এরই মধ্যে বিতর্ক বেধেছে তৃণমূলের দুই নেতা মদন ও কল্যাণের বক্তব্য নিয়ে। মদন বলেছেন, “যদি ওই ছাত্রী না যেতেন (কলেজে), বা কাউকে বলে যেতেন বা দু’জন বান্ধবীকে নিয়ে যেতেন, তা হলে এই ঘটনা ঘটত না! যারা নোংরা ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা সুযোগের ব্যবহার করেছে!” এর আগে কল্যাণ বলেছিলেন “এক জন বন্ধু তাঁর বান্ধবীকে ধর্ষণ করলে, সেখানে নিরাপত্তা কী করতে পারে?” এই প্রেক্ষিতে বিজেপি মুখপাত্র সম্বিতের বক্তব্য, “মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না-করতে পারলে, সেই সরকার দায়িত্ব ছেড়ে দিক।” বিজেপি নেতা তাপস রায়ও বলেছেন, “মদন কি মেনে নিচ্ছেন, মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর শাসনে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা এতটাই খারাপ যে, মহিলারা একা কোথাও যেতে পারবেন না?” সিপিএমের পলিটব্যুরো প্রাক্তন সদস্য বৃন্দা কারাটের কটাক্ষ, “তৃণমূলের ওই সাংসদ ‘ধর্ষণ-সংস্কৃতি’র দূত! ওঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হবে না কেন?” বিতর্কের মুখে কল্যাণ, মদনের বক্তব্যের নিন্দা করে তৃণমূলও বলেছে, ‘ওই বক্তব্যের সঙ্গে দল কোনও ভাবেই এক মত নয় এবং এই মন্তব্যগুলির কড়া নিন্দা করা হচ্ছে। যারা নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের যেন কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।’ পরে কল্যাণ অবশ্য গণধর্ষণের ওই ঘটনায় দোষীদের ফাঁসি চেয়েছেন।
ঘটনাচক্রে, এরই মধ্যে আর জি কর-কাণ্ডের তদন্তে সিবিআই ‘ব্যর্থ’ বলে দাবি করে দক্ষিণ কলকাতার ঘটনায় রাজ্য পুলিশই তদন্ত করুক বলে দাবি তুলেছেন বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। এই প্রসঙ্গে দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্তের দাবি, “এটা ওঁর ব্যক্তিগত মত। দলের অবস্থান নয়।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)