পোড়াডাঙা স্টেশনে টিকিট কাটার ভিড়। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
‘ও চাচা, টিকিট কেটেছেন?’ চটপট জবাব, ‘না, পরের স্টেশনেই নামবো।’ সোলেমান চাচার এমন জুতসই উত্তর শুনেও পথ আটকে দাঁড়ালেন মিজানুর। অগত্যা গুটি গুটি পায়ে চাচা টিকিটের লাইনে দাঁড়ালেন। নিজের জন্য একটা ফুল টিকিট আর নাতনির জন্য হাফ টিকিট কিনে তবেই ট্রেনে চাপার ছাড়পত্র মিলল। রেলের টিকিট পরীক্ষক নন, মিজানুর পাশের গ্রামেরই তরুণ। পোড়াডাঙা রেল স্টেশন এখন আশপাশের ১২টি গ্রামের এমনই কিছু তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর কড়া পাহারায় রয়েছে। তাদের দৌলতে কারওরই টিকিট না কেটে ট্রেনে ওঠার জো নেই।
ঘটনার সূত্রপাত গত ১ নভেম্বর। ওই দিন আজিমগঞ্জ–ফরাক্কা রেল পথের পোড়াডাঙা স্টেশন থেকে দু’জোড়া প্যাসেঞ্জার ট্রেনের স্টপেজ তুলে দিয়েছেন পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের গ্রামগুলির মানুষজন রেল অবরোধ করেন। আটকে প়ড়ে ১২টি ট্রেন। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ নাছোড়। মালদহের ডিআরএম রাজেশ আগরওয়াল জানান, এই স্টেশনে থামে ৫ জোড়া ট্রেন। ১২টা গ্রামের মানুষ তাতে রোজ যাতায়াত করেন। অথচ প্রতিদিন টিকিট বিক্রি হয় সাকুল্যে ৮০ খানা। তাহলে বিনা টিকিটের যাত্রী বহন করে রেলের ফায়দা কি!
অবশেষে গ্রামবাসীদের সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের রফা হয়, টিকিট বিক্রি যদি বাড়ে তাহলে ট্রেনগুলির স্টপেজ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। উপরন্তু কলকাতাগামী ডেমু প্যাসেঞ্জার ট্রেনও স্টপেজ দেবে পোড়াডাঙা স্টেশনে। আর তার পরেই নড়ে চড়ে বসেন গ্রামগুলির বাসিন্দারা। শ’খানেক তরুণ পালা করে স্টেশন বসে পড়েন পাহারা দিতে।
পাহারাদার তরুণেরা জানালেন, পোড়াডাঙা ছাড়াও গোবর্ধনডাঙা, মানসিংহপুর, নতুনপাড়া, দস্তুরহাট, গয়সাবাদ, বিশ্বনাথপুর, হরিণাডাঙা, খাটুয়া এবং চিলাডাঙা-সহ ১২টি গ্রামের মানুষ এই স্টেশনের উপর নির্ভরশীল। জঙ্গিপুর মহকুমার এই গ্রামগুলি থেকে সড়ক পথে ব্লক সদর সাগরদিঘি যেতে হলেও ২৪ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। তার চেয়েও বড় কথা এখানে কোনও বাস পরিষেবা নেই। ভরসা বলতে একমাত্র ট্রেন। গ্রামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী মিজানুর রহমান জানান, ‘বাজারহাট করতে নিদেন পক্ষে আজিমগঞ্জ যেতে হয়। সেটাও এখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূর। ৪০ কিলোমিটার দূরে মহকুমার সদর রঘুনাথগঞ্জ। ট্রেনের স্টপেজ উঠে যাওয়ায় তাই সবাই খুবই বিড়ম্বনায় পড়েছিল।’’ মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী তথা গ্রামেরই বাসিন্দা নুরুল হকের থেকে জানা গিয়েছে, ৪ নভেম্বর গ্রামবাসীরা মালদহ গিয়ে ডিআরএমের সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি টিকিট বিক্রি বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে পরের দিনই মানসিংহপুরের মাঠে সভা করেন কয়েকশো গ্রামবাসি। সেখানেই স্টেশনে পাহারা বসানোর বন্দোবস্ত করা হয়। আর ঠিক হয়, সপ্তাহের প্রতিদিন ১২জন স্বেছাসেবক টিকিট কেনার জন্য স্টেশনে প্রচার চালাবেন।
এই ব্যবস্থাতেই ভোল পাল্টে যায় স্টেশনটির। রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এই ক’দিনেই পোড়াডাঙা স্টেশন থেকে টিকিট বিক্রি বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। আর তাই জেনে গত ১৬ নভেম্বর সটান স্টেশনে চলে এসেছিলেন ডিআরএম স্বয়ং। গ্রামবাসিদের কীর্তি দেখে খুশি হয়ে তিনি জানিয়ে গিয়েছেন, এই ভাবে চললে খুব শিগ্গির স্টপেজ ফিরে পাবে পোড়াডাঙা।
রেল কর্তার আশ্বাসে আজকাল পোড়াডাঙা স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন পড়ছে রোজই। সোলেমান চাচা আর বিনোদ মণ্ডল মিলে তাগাদা দিয়ে নাজেহাল করে দিচ্ছেন কাউন্টারের কর্মীকে— লম্বা লাইন পেরিয়ে টিকিট পেতে পেতেই ট্রেনটা আবার না চলে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy