Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
চাষের দিশা

ঝুরঝুরে মাটিতে চিনাবাদামের চাষ

হুগলি জেলায় প্রাক-খরিফ মরসুমে চিনাবাদামের চাষ করে থাকেন অনেকে। রাজ্যের অন্যত্রও খরিফ ও রবি মরসুমের তুলনায় ফাল্গুন-চৈত্র মাসে চিনাবাদাম চাষের চল বেশি। শুধু অর্থকরী ফসল হিসাবেই নয়, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতেও এর অসীম ভূমিকা।

হরষিত মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৫৮
Share: Save:

আলু তুলে বাদাম চাষ।
হুগলি জেলায় প্রাক-খরিফ মরসুমে চিনাবাদামের চাষ করে থাকেন অনেকে। রাজ্যের অন্যত্রও খরিফ ও রবি মরসুমের তুলনায় ফাল্গুন-চৈত্র মাসে চিনাবাদাম চাষের চল বেশি। শুধু অর্থকরী ফসল হিসাবেই নয়, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতেও এর অসীম ভূমিকা। গম, তিল, অড়হর ও আউশ ধানের সঙ্গে ‘সাথী ফসল’ হিসাবে এই চাষ করা যায়। একক ভাবে চাষ করেও ভাল লাভ হয়।

ঝুরঝুরে মাটি

চিনাবাদামের ফুল মাটির উপরে ফুটলেও গর্ভাশয়ের নীচের যে বৃন্তটি শুঁটি গঠন করে, সেটি মাটির নীচে চলে যায় এবং সেখানে পুষ্ট হয়ে বাদামে পরিণত হয়। এই কারণে ভাল নিকাশি ব্যবস্থা আছে এমন হাল্কা, ঝুরঝুরে দোঁয়াশ মাটিতে বাদাম চাষ করা উচিত।

উন্নত জাত

দাঁড়ানো বা গুচ্ছ: এ কে ১২-২৪,

টিএমভি ৭, টিএমভি ১০,

এমএইচ ২, জে ১১, পোলচি ১, টিপিজি ৩৭।

ছড়ানো জাত: বি ৩০, বি ৩১।

হাইব্রিড: ট্যাগ ২০, ট্যাগ ২৪।

মাটি শোধন

এক একর জমির জন্য১০০ কেজি ভাল পচানো গোবর সারের সঙ্গে এক কেজি করে উপকারী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া (ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ও সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স) মিশিয়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে এক সপ্তাহ আর্দ্রতা ও ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এতে উপকারী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ১০-১২ গুণ বৃদ্ধি পাবে। শেষ চাষের এক সপ্তাহ আগে মাটিতে প্রয়োগ করে মাটি শোধন করলে টিক্কা, শিকড় ও গোড়াপচা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। ল্যাদা পোকা লাগার ভয় থাকলে এক একর জমিতে ৪ কেজি ফোরেট ১০জি অথবা কার্বোফিউরন ৩ জি শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।

বীজ শোধন

প্রতি লিটার জলে পাঁচ গ্রাম উপকারী ছত্রাক (ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি) মিশিয়ে অথবা প্রতি কেজি বীজে পাঁচ গ্রাম ক্যাপটান মিশিয়ে শোধন করে নিলে বেশ কিছু রোগের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। ল্যাদা পোকার আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে প্রতি লিটার জলে পাঁচ গ্রাম অ্যাসিফেট ৭৫% ডব্লুপি মিশিয়ে অথবা প্রতি কেজি বীজে ১০ মিলি ক্লোরোপাইরিফস ২০% ইসি মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

কত দূরে

দাঁড়ানো জাত হলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-৩০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব অন্তত ১৫ সেমি হওয়া চাই। ছড়ানো জাতের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০-৪৫ সেমি ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১৫ সেমি।

সেচ

একটা সেচ দিয়ে জো অবস্থায় বীজ বুনতে হবে। বেলে মাটি হলে ৫ দিন অন্তর, দোঁয়াশ মাটি হলে ১০ দিন অন্তর হাল্কা সেচ দেওয়া উচিত। ফুল আসা ও শুঁটি পাকার সময় যেন অবশ্যই সেচ দেওয়া হয়।

জিপসাম-চুন

বীজ বোনার ২৪-৩০ দিনের মধ্যে যেহেতু ফুল আসে, সেহেতু ২০ দিনের মাথায় প্রতি একরে ৮০-২০০ কেজি জিপসাম, ৭-১৪ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ প্রয়োগ করে মাটি ধরানো উচিত। এতে বেশি সংখ্যক ও গুণমানের শুঁটি মেলে। চুন প্রয়োগ করলে অর্বুদ ও শুঁটির গঠন ভাল হয়।

আলফাএনএএ

শুঁটি গঠন ও বৃদ্ধিতে আলফা ন্যাপথলিন অ্যাসেটিক অ্যাসিডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই ফুল আসার সময় ২৫-৪০ ও ৫০-৬০ দিনের মধ্যে আলফা এনএএ-এর দু’বার ব্যবহার ফলন বাড়ায়।

মালিক হাইড্রোজাইট

এটি প্রয়োগ করলে বাদামে‌র আকার বাড়ে। শুঁটি পরিপক্ক হওয়ার আগে প্রতি ৩ লিটার জলে ১ মিলি এমএইচ আঠা-সহ গুলে স্প্রে করলে ২০-৩০ দিন পর্যন্ত বাদামের অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা রোধ হয়। তাই শুঁটি জলে ভিজলেও অঙ্কুরিত হয় না এবং সহজেই ফসল কর্তন করা যায়।

টিক্কা রোগ

বীজ আর মাটি শোধন করলে এই রোগের আক্রমণ কমে। এরপরেও রোগ হলে প্রতি লিটার জলে পাঁচ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি মিশিয়ে অথবা প্রতি লিটার জলে ম্যানকোজেব ৮৫% ডব্লুপি মিশিয়ে আঠা-সহ বিকালের দিকে গাছে ছড়াতে হবে।

গোড়াপচা ও অন্য

গোড়াপচা রোগে গোড়ায় কালো দাগ পড়ে ও শিকড় পচে যায়। ফলে কচি চারাগাছ মারা যায়। এই রোগের প্রতিকার হিসাবে প্রতি লিটার জলে কার্বেন্ডাজিম ৫০% ডব্লুপি এক গ্রাম মিশিয়ে বা পেনসাইকিরন ১.৫ মিলি অথবা ভ্যালিডামাইসিন ৩% এল ২ মিলি ভাল করে মিশিয়ে বিকেলের দিকে গাছের গোড়ায় ছেটাতে হবে।

কলার রট সারানোর উপায় শস্য পর্যায় আর বীজশোধন। এ ছাড়া, মরচে রোগে বাদামের পাতায় লাল রঙের ছোট ছোট দাগ দেখা যায়। ট্রাইসাইক্লাজোল ৭৫% ডব্লুপি ০.৫০ গ্রাম প্রতি লিটার জলে আঠা-সহ ভাল করে গুলে স্প্রে করতে হবে।

ল্যাদা পোকা

ধূসর-বাদামি রঙের এই পোকা রাতের বেলা মাটির নীচে চারার কচি শিকড় কুরে খায়। ফলে চারাগাছ শুকিয়ে যায়। ধরে টানলে সহজে উঠে আসে এবং গোড়া কাটা অবস্থায় দেখা যায়। এর জন্য বীজ ও মাটি শোধন জরুরি। জমিতে কঞ্চি বা ধঞ্চে বসিয়ে পতঙ্গভূক পাখিদের ডেকে আনলে, ওরা ল্যাদা পোকা খায়। জমিতে কিছু জায়গায় সবুজ জাতীয় ঘাস বা গাছের পাতা স্তূপ করে রাখলে সকালে ওই স্তূপ উল্টে ল্যাদা পোকা পেয়ে যাবেন। পোকাদের কেরোসিন তেলে ডুবিয়ে মারতে হবে বা মাছ চাষ হয় এমন পুকুরে ফেলে দিতে হবে। এ ছাড়াও ১৫ কেজি বালির সঙ্গে ৬০০ মিলি ক্লোরোপাইরিফস ২০% ইসি মিশিয়ে জমিতে ছড়ালে কাজ দেয়। ৫০০ গ্রাম সাদা আটার সঙ্গে ২০০ গ্রাম ঝোলা গুড়, ৩০ গ্রাম অ্যাসিফেট ৭৫% ডব্লুপি জল-সহ মিশিয়ে ছোট ছোট গুলি করে জমিতে বিকেলের দিকে ছড়িয়ে উপকার পেতে পারেন।

শুঁয়ো পোকা

প্রতি লিটার জলে প্রোফেনফস ৫০% ইসি ১ মিলি অথবা ডাইক্লোরভস ৭৬% ইসি ১ মিলি অথবা ডায়াফেনথিউরন ৫০% ডব্লুপি ১ গ্রাম গুলে আঠা-সহ বিকেলের দিকে ১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। তিনটির মধ্যে দু’টি কীটনাশক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করলে শুঁয়ো পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একই ভাবে ‘লিফমাইনর’ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

সাদা পোকা

গাঙ্গেয় সমভূমিতে এই পোকার উপদ্রব খুব বেশি হয় না। তবুও গভীর ভাবে জমি চাষ, আশপাশের ঝোপ পরিষ্কার ইত্যাদি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। দু-একটা গাছ রেখে দিলে সেখানে এই পোকা পূর্ণাঙ্গ দশায় আশ্রয় নেবে। তখন সেখানে ক্লোরোপাইরিফস ২০% ইসি ২.৫ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

বীজ বোনার পর গুচ্ছ জাতের ক্ষেত্রে
৮৫-৯৫ দিন, ছড়ানো জাতের ক্ষেত্রে
১০০-১১০ দিন ও হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে ১১০-১২৫ দিন সময় লাগে। প্রতি একর জমির বাদাম তোলার জন্য ৪০-৫০টি পূর্ণ দিবস শ্রমিকের প্রয়োজন। বাদাম চাষে
নামার আগে এটা মাথায় রাখবেন।

লেখক খানাকুল ১ ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা।

নাবি ধসা প্রতিকারে কিছু কথা

আশিস চক্রবর্তী

আলু চাষে নাবি ধসার প্রকোপ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে এই রাজ্যে। এর প্রতিকারে ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই।

এই মুহূর্তে সায়মক্সানিল + ম্যানকোজেবের মিশ্রণ ৩ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে অথবা ফেনামিডন + ম্যানকোজেবের মিশ্রণ ৩ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে। চাষিরা যদি ডাইমিথোমরফ গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করতে চান, তাহলে সঙ্গে ম্যানকোজেব মিশিয়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ডাইমিথোমরফ ২ গ্রাম + ম্যানকোজেব ৩ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করুন। স্প্রে বন্ধ করা যাবে না। সাত দিন পর পর স্প্রে করে যেতে হবে। প্রতি হেক্টরে স্প্রে করার জন্য ৯০০-১০০০ লিটার জল লাগবে। মনে রাখবেন গাছের উপর থেকে নীচ বরাবর স্প্রে করতে হবে। নীচের পাতার উপরে বেশি নজর দিতে হবে। চাষিরা তাদের নিজ নিজ জমিতে মোটামুটি একই সময়ে স্প্রে করার চেষ্টা করবেন। তা না হলে ওষুধের কার্যকারিতা ভাল হবে না। এই সময় জলসেচ দেওয়া যাবে না। খুব প্রয়োজন হলে শেষের দিকে জলসেচ দেওয়া যেতে পারে। তবে ভেলির এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভেজানো যাবে না। দুপুরের মধ্যে সেচের কাজ শেষ করতে হবে। বিকেলে সেচ দেওয়া চলবে না।

লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

জলদি জবাব

আপনার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক ব্রহ্মচারী।

নিম গাছ আর কারি পাতা গাছের চারা টবে লাগিয়েছিলাম। দু-একটা পাতা গজালেও গাছ এতটুকুও বাড়েনি। কী করব?—পম্পা দত্ত

গাছের কতটা যত্ন নিয়েছেন, সেটা জানাননি চিঠিতে। এমনিতে কারি পাতা গাছের ডাল বছরে চার বার ছাঁটতে হয়। সেই ছাঁটা ডাল থেকে পাতা সংগ্রহ করে নেবেন। আর ফুল এলে সেটা ছেঁটে দিতে হবে। তা হলে পাতা বাড়বে। টবে গাছটা লাগানোর সময় মাটি তৈরি করেছিলেন কি না জানি না। নিয়ম হচ্ছে টবের ১/৪ ভাগ জৈব সার। যদি তা না করে থাকেন, তা হলে এই বেলা আলতো করে মাটি খুঁড়ে জৈব সার মিশিয়ে দিন। এর পর গাছের গোড়ায় বরবটি, শিম বা ছোলার বীজ ছড়িয়ে দিন। দু’দিকে দু’টো ছোলা গাছ হলেই হবে। ওই গাছ মাটিতে নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে পুষ্টি সংগ্রহে সাহায্য করবে।

কলমের দু’টি আম গাছ ছ’মাস আগে পুঁতেছিলাম গোবর সার দিয়ে। বৃদ্ধি সেই রকম হয়নি। আর কী করা যায়। —দেবাশিস মল্লিক,দুর্গাপুর

গোবর সার কতটা দিয়েছেন? ভাল ভাবে পচানো ছিল কি? তিন ফুটের গর্ত খুঁড়ে জৈব সার মিশিয়ে গাছ লাগাতে হয়। আর বর্ষার আগে ও পরে নিয়ম করে সার দিতে হয়। ছ’মাসের গাছের ক্ষেত্রে পরিমাণটা ২০ কেজি জৈব সার, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট, ৫০ গ্রাম মিউরিয়েট অফ পটাশ। বয়স অনুযায়ী গুণ করে প্রতি বছর সারের পরিমাণ বাড়াবেন, যত দিন না ফুল আসে।

চাষের মূলধন কী ভাবে মিলবে? শস্যবিমা, কিসান ক্রেডিট কার্ড ছাড়া আর কী পরিষেবা মেলে ব্যাঙ্ক থেকে? সম্প্রতি বারুইপুরে এক কর্মশালায় এই সংক্রান্ত আলোচনা হল।নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Peanut farming
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE