E-Paper

ভোট এলেই মাপজোক, বাঁচার রাস্তা কঙ্কালসারই

বরাদ্দ অনেক। খরচও হয়। তবু এখনও রাস্তা না থাকায় পেটে টান, এই রাজ্যে। কেন?

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৫৯
একাধিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হাবিবুর রহমান।

একাধিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হাবিবুর রহমান। — নিজস্ব চিত্র।

গাড়ি থেকে নামতেই খেতের কাজ থামিয়ে বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, ‘‘মাপজোক করতে এসেছেন? ভোট বোধহয় এসে গেল, তাই না?’’ চোখমুখে, গলার স্বরে শ্লেষ, বিরক্তি নেই। নিছকই কৌতূহল।

যে জায়গায় নামলাম, তার পর গাড়ি আর চলে না। দু’চারটে সাইকেল, টোটো চলছে। দূরে ছোট ট্রাক্টর। ইতস্তত হেঁটে চলেছেন দু’চারজন। এঁকেবেঁকে চলা রাস্তা গর্তে ভরা ক্ষতবিক্ষত চেহারা নিয়ে এলিয়ে পড়ে রয়েছে। এই রাস্তাই মাপার কথা বলছিলেন বৃদ্ধ। অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে, ভোটের আগে রাস্তার মাপ নেওয়া হয়। ঘন ঘন সরকারি কর্মীরা আসেন। জনপ্রতিনিধিরা আশ্বাস দেন, ‘‘আর তো কয়েকটা দিন। তার পরেই সব দুর্ভোগ থেকে মুক্তি।’’ ‘পর’টা আর আসে না। ঘরে ঘরে বাড়তে থাকে অভাব।

পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের কানপুর মোড় থেকে সেরুয়া, নৃসিংহপুর হয়ে সাহেবগঞ্জ মোড় পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার রাস্তা। ২০১৭ সালে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। বছর খানেক পিচের রাস্তা পেয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। তার পরেই হাড়গোড় বেরিয়ে অবস্থা যা দাঁড়ায়, তা তাঁদের কথাতেই, ‘আগের চেয়েও ভয়ানক’। ফল যা হওয়ার তাই। গাড়ি তো দূর, এই রাস্তায় সাইকেল চালাতে গেলেও এখন উল্টে পড়তে হয়। সেরুয়া গ্রামের তাপস ঘোষ পেশায় দুধ বিক্রেতা। সাইকেলে চড়ে রোজ ৭০ লিটারের মতো দুধ বিক্রি করেন। বললেন, ‘‘এত খানাখন্দ, সাবধানে চালিয়েও শেষরক্ষা হয় না। সাইকেল উল্টে প্রায়দিনই দুধ পড়ে যায় রাস্তায়। খালি হাতে ফিরতে হয়। বুঝতে পারি, বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে মাঝেমধ্যে না খেয়ে থাকাটাই আমাদের ভবিতব্য। খারাপ তো আমরা ছিলামই, ক্রমশ তা আরও খারাপের দিকে এগিয়েছে।’’

এই রাস্তা ধরেই চারটি গ্রাম।

কানপুর, চণ্ডীপুর, নৃসিংহপুর আর সেরুয়া। বাসিন্দাদের মূল জীবিকা কৃষি আর পশুপালন, ভয়াবহ রাস্তার জেরে যা মুখ থুবড়ে পড়ছে। ভরপেট খাবার নেই। মাথায় ঋণের বোঝা। বড় গাড়ি কখনওই ঢোকে না। তাই টোটোয় চাপিয়ে আনাজ বাজারে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এই এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার জন্য সেই টোটোর ভাড়া কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। ২০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা। গ্রাম থেকে এক বার টোটো বোঝাই করে আনাজ বাজারে নিয়ে যেতে ১০০ টাকা নেওয়ার কথা। নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। টোটো চালক ধীরেন মাঝি বললেন, ‘‘ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় নেই। এই রাস্তায় গাড়ি চালালে মাঝেমধ্যেই কলকব্জা বিগড়োয়। বিস্তর খরচ। ভাড়া না বাড়ালে তো আমাদেরও পেটেটান পড়বে।’’

ধানের জমি থেকে সাহেবগঞ্জ গ্রাম বড় জোর তিন কিলোমিটার। ধান বয়ে আনার জন্য ছোট ট্রাক্টর আগে ৬০০ টাকা নিত। এখন ১০০০ টাকা। আগে ট্রাক্টরে ২০ কাঠা জমির ধান তোলা যেত। এখন ১০ কাঠার বেশি ধান তোলার অনুমতিই মেলে না। চালক বলছেন, ‘‘গাড়ি উল্টে যাবে। বেশি ভার নেওয়া যাবে না। কিছু বাড়তি টাকা পাওয়া যাবে বলেই তো এই রাস্তায় ঢুকছি। না হলে এখানে গাড়ি ঢোকানোর বিপদ কে না জানে! বেশিরভাগ লোক এর ধারেকাছে আসে না।’’

সেরুয়ার বৃদ্ধ কৃষক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বললেন, ‘‘ধান রোয়ানো, নিড়েন, কাটা-ঝাড়া সব মিলিয়ে বেশ কয়েকজন রাখতে হয়। তাদের মজুরি, সার, ওষুধ, সব মিলিয়ে টাকার অঙ্কটা বেশ বড়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ট্রাক্টরের খরচ বেড়েই চলেছে। আমাদের মতো চাষিদের লাভ কিছুই থাকছে না।’’ এখানেই শেষ নয়। বস্তা পিছু ধানের দামও ৭০-৮০ টাকা করে কমিয়ে দিচ্ছে ফড়েরা। রাস্তার জন্য। ‘‘রাস্তা খারাপ, গাড়ি ভাড়া বেশি। তাই আগের দাম দেওয়া যাবে না’’—যুক্তি এটাই।

রাস্তা তৈরির পর পাঁচ বছর ঠিকাদার সংস্থার দেখভালের দায়িত্ব থাকে। অভিযোগ, সে কাজ তো তারা করেইনি। রাস্তাও এমনই তৈরি করেছে যে বছর ঘুরতেই তা কার্যত কাঁচা রাস্তার চেহারা নিয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের জেলা পরিষদের সভাধিপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার বললেন, ‘‘ওই সংস্থা কোনও শর্তই মানেনি। ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।’’ কিন্তু তাতে এলাকার মানুষের সমস্যার সুরাহাটা হল কই? তিনি বলেন, ‘‘দিন কয়েকের মধ্যেই বৈঠক হবে। খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু হয়ে যাবে। গ্রামোন্নয়ন দফতরের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।’’

গ্রামের মানুষ বলছেন, এমন আলোচনার কথা তাঁরা অনেক শুনেছেন। কিন্তু কোনও আলোচনারই শেষ জানতে পারেননি। বড় দুর্ঘটনা ঘটলে, কোনও চাষির মৃত্যুর খবর নিয়ে হইচই হলে পঞ্চায়েত মাঝেমধ্যে ইট ফেলে ছোটখাটো জোড়াতাপ্পির কাজ করে। কিন্তু সে সবও বেশি দূর এগোয় না। বাসিন্দাদের আক্ষেপ, ‘‘এগোবে কী করে? রাস্তা সারানোর কাজ করতে এলে চার দিক থেকে টাকা নেওয়ার জন্য ঘিরে থাকে মেজ-সেজ-ছোট নেতারা। ১০ লাখ টাকার কাজে যদি ৬ লাখ খেয়েই নেয় এরা, তা হলে কারাই বা কাজ করতে আসবে?’’

কেউ আসে না। তাই রাস্তার স্বাস্থ্য খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়। দেরি করে বাজারে পৌঁছলে ফসলের দাম পড়ে যায়। আনাজ নরম হয়ে গেলে বিক্রিই হয় না। ভাতারে কোনও হিমঘর নেই। পরিকল্পনা রয়েছে, তবে তা কবে হবে কেউ জানে না। উৎপাদন ভাল হলে হিমঘর না থাকায় জলের দরে বিক্রি করতে হয়।। ভাল ফলন হলে এখানকার মানুষ আনন্দিত হন না, বরং তাঁদের আতঙ্ক হয় কোন পথে সেই ফসল বাজারে পাঠাবেন!

রাজ্যের কৃষি দফতরের কর্তারা মানছেন, পরিবহণ ব্যয় যখন উৎপাদন খরচের ২০-৩০% ছাড়িয়ে যায়, তখন কৃষকের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর এ ভাবেই খারাপ রাস্তা গ্রামীণ কৃষিকে সরাসরি দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়। সেরুয়ার মতো গ্রামগুলি তারই উদাহরণ। এখানকার কৃষকেরা একটাই কথা বলেছেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ‘‘আমরা ফসল ফলাই। কিন্তু ফসল ঘরে তোলার পরেই আমাদের আসল যুদ্ধ শুরু।’’

ডাঙ্গাপাড়ার রাস্তার ধারে বসেছিলেন হাবিবুর রহমান। এলাকার একাধিক দুর্ঘটনার তিনি সাক্ষী। মৃত্যু দেখেছেন। দেখেছেন না-খেয়ে থাকার দিন। বললেন, ‘‘নেতাদের হাতেপায়ে ধরেছি। কেউ কিছু করেনি। তোমরা একটু দ্যাখো না গো, যাতে আমরাও একটু খেয়েপরে বাঁচতে পারি।’’

গ্রামে ঢোকার মুখে দেখেছিলাম, খেত জোড়া ফসল আলো করে রয়েছে চার ধার। গ্রামে সে আলো পৌঁছচ্ছে কই?

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Poor condition of road road construction West Bengal government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy